পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գֆ Հ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী নহে, চাবুক খাইবার যোগ্যতায়; চাবুকধারী অনুগ্রহ করিয়া আমাদিগকে চাবুক মারিতে নিরস্ত থাকিয়া সে অপমান দূর করিতে পারে না- সে অপমান দূর করা একমাত্র আমাদের নিজের হাতে। কিন্তু আদুরে ছেলের মতো আমরা নিজেদের কেবল আদর দিতেই জানি এবং পরের নিকট কেবল আবদার কাড়িতেই শিখিয়াছি। আমাদের দেশীয় পত্রিকা নাকী সুরে নালিশ করিতেছেন যে, ইংরাজ গবর্মেন্ট তাহার ভূতাদিগকে আদর দিয়া তাহাদিগকে চাবুক মারিতে শিখাইতেছেন- সম্পাদক মহাশয় এ কথা কেন ভুলিয়া যান যে, গবর্মেন্টের প্রতি অভিমান করিয়া এবং দেশের লোককে আদর দিয়া তিনি দেশের লোককে চাবুক খাইতে শিখাইতেছেন? যখন ঘরের ছেলে পরের পদাঘাত অনায়াসে শিরোধাৰ্য করিয়া আদর পাইবার জন্য বাড়িতে কঁাদিতে আসে তখন অতিবৃদ্ধ পিতামহীর ন্যায় সেই পরকে গৃহ-কোণ হইতে বুপান্ত করিতে বসার চেয়ে ছেলেটাকে বেত্ৰাঘাত করিয়া বাড়ি হইতে বিদায় করিয়া দেওয়া উচিত। চাবুক খাইবার জন্য আমাদিগকে সহস্রাবার ধিক- এবং চাবুক খাইয়া সাশ্রু নোত্রে ও সজল। নাসিকায় গবর্মেন্টের প্রতি রাগ করিতে বসার জন্য আমাদিগকে ততোধিক ধিক। জাতীয় আদর্শ আমরা স্বজাতির নিকট হইতে যদি কিছুমাত্র মনুষ্যত্ব আশা না করি তবে তদপেক্ষা আত্মাবমাননা আর কিছুই হইতে পারে না। আমরা সকরুণ সমেহ স্বরে বলিতে থাকি, আহা, আমরা বড়ো দুর্বল- আমাদিগকে যদি কেহ আঘাত করে আমরা তাহার প্রতিঘাত করিতে পারিব না— আমাদিগকে যদি কেহ অপমান করে তবে আমরা তাহার প্রতিকার করিতে অক্ষম- অতএব যাহারা আমাদিগকে আঘাত ও অপমান করে তাহারা অতি পাষণ্ড- শুনিয়া আমরা এত সস্তুনা লাভ করি, নিজেদের প্রতি এত অধিক মেহরাসাদ্ৰ হইয়া উঠি যে, আপনি অক্ষমতায় লজ্জা অনুভব করিবার অবসর পাওয়া যায় না। আমরা স্বজাতির নিকট হইতে তিলমাত্র সমর্থ্য প্রত্যাশা করি না বলিয়া আমাদের সামর্থ্য প্রকাশের চেষ্টামাত্ৰ চলিয়া যায়, আমাদের জাতীয় সম্মানবোধের অন্ধুরমাত্র উঠিতে পারে না। আমাদের জাতীয় আদর্শ সর্বদা উচ্চ রাখিতে হইবেসেই আদর্শ হইতে লেশমাত্র স্বলন হইলে সুতীব্র ভৎসনা দ্বারা আত্মপ্লানি উৎপাদন করিয়া দিতে হইবে, যে ব্যক্তি কাপুরুষতা প্রকাশ করিয়া স্বজাতির লাঞ্ছনার কারণ হইবে তাহার প্রতি অজস্র স্নেহ বৰ্ষণ না করিয়া তাহাকে আমাদের সমবেদনা লাভের অযোগ্য বলিয়া একবাক্যে তিরস্কৃত করিতে হইবে- তবেই আমাদের এই অগাধ অধঃপাত হইতে মাথা তুলিয়া উঠিবার সম্ভাবনা থাকে। হইতে পারে, ম্যাজিষ্ট্রেট বেল কেশবলাল মিত্ৰকে মারিয়া ভালো কাজ করেন নাই, কিন্তু যে কেশবলাল মারা খাইয়া ভুমে লুটাইয়াছিল তাহার মতো অবজ্ঞার পাত্ৰ পৃথিবীতে দুর্লভ। নাই, কিন্তু যে জমিদার উপস্থিত ক্ষেত্রে তাহার প্রতিকারের চেষ্টামাত্র না করিয়া সমস্ত উপদ্ৰব • নতশিরে বহন করিয়াছিল সে যৎপরোনাস্তি হেয়। এই সকল কাপুরুষেরা অপমান সহ্য করিয়া স্বজাতিকে হীন আদর্শ দেখায় এবং পরজাতিকে স্পর্ধিত করিয়া তুলে। অপূর্ব দেশহিতৈষিতা অথচ আশ্চর্য এই যে, আমাদের সম্পাদক মহাশয়গণ জাতীয় আদর্শকে উচ্চে তুলিবার কিছুমাত্র চেষ্টা না করিয়া পরজাতিকে সর্বদা মহত্ত্বের পথে অটল রাখিতে প্ৰাণপণ প্রয়াস পাইয়া থাকেন। সে সম্বন্ধে তাঁহাদের সতর্কতার বিশ্রাম নাই। ইংরাজেরা রক্তমাংসের মানুষ নহেন, তাহারা