পরিশিষ্ট ৭৩১ • রাজদ্ৰোহও যে অনেক সময় মৌখিক হইতে পারে সে তাহারা খেয়াল করেন না। হৃদয়ে আমাদের রাজদ্রোহ নাই, যদি কখনো চিত্তক্ষোভে অনবধানে মুখে বিরুদ্ধ কথা বাহির হয় তাহা কৰ্ণপাতের যোগ্য নহে। At . জগদীশ্বরের রাজ্যই ধরণীশ্বরের রাজত্বের আদর্শ। ঈশ্বর মনুষ্যকে অনেক স্বাধীন অধিকার দিয়াছেন, মনুষ্য তাহার অসদাব্যবহার করিয়া পদে পদে দণ্ডনীয় হয়। কিন্তু তাই বলিয়া সমূলে স্বাধীনতা হইতে বঞ্চিত হয় না। আমাদের নরপতি, বিশ্বাপতির এই বিধান স্মরণ রাখিলে রাজনীতির উচ্চ আদর্শ স্থাপন করিতে পারিতেন। এই তো গেল রাজদ্রোহের ধুয়া। তাহার পরে আমাদিগকে বিবিধ প্রকারে দমনের জন্য আয়োজন নানা আকারে দেখা যাইতেছে। ইহার মূলে শাসনকর্তাদিগের ক্ষমতা, এবং প্রতিষ্ঠা বৃদ্ধির চেষ্টা। ভারত-রাজতন্ত্রে বিচার বিভাগ এবং কর্তৃত্ব বিভাগের অধিকার, ন্যায়াধীশ এবং দণ্ডাধীশের ক্ষমতা অনেক স্থলে একাধারে বর্তমান বলিয়া অনেক অন্যায়ের সৃষ্টি হইয়া থাকেএই দুই ক্ষমতার পৃথকীকরণের জন্য দীর্ঘকাল আন্দোলন চলিতেছে, পাছে সেই যুক্তিযুক্ত আন্দোলন সফল হয় এইজন্যই বুঝিবা তৎপূর্বেই কর্তৃপুরুষের ক্ষমতা অসংগতরাপে বৃদ্ধি করা হইতেছে। অনেক সময় দণ্ডাধীশ যাহাকে দোষী বলিয়া খাড়া করেন ন্যায়াধীশের বিচারে সে খালাস পায়- ইহাতে দণ্ডবিধানের একটা ব্যাঘাত ঘটে। কিন্তু চাণক্যের ন্যায় আমাদের কর্তারা স্থির কৱিয়াছেন- “তাড়নে বহবো গুণাঃ”- অতএব দমন-তাড়নের শক্তিকে তাহারা অপ্ৰতিহত করিতে চান। এক তো এমন এক ধারা বাহির হইল যাহাতে কোনো বিচারই নাই- তাহার পরে যেখানে বিচার আছে সেখানেও নূতন সংশোধিত দণ্ডবিধি এমন সকল বাধা স্থাপন করিয়াছে, যাহাতে অভিযুক্তগণ আপনি নিরপরাধ প্রমাণের চিরপ্রচলিত অনেকগুলি সুযোগ হইতে বঞ্চিত । হইয়াছে। সওয়াল-জবাবের অধিকার হ্রাস করা হইয়াছে; পুলিসের ডায়ারি তদন্ত করিয়া কৃত্রিম প্রমাণ ধরিতে পারিবার যে উপায় ছিল তাহাও রোধ করা হইয়াছে; অবিচারের আশঙ্কায় এক হাকিমের হস্ত হইতে অন্য হাকিমের হস্তে মকদ্দমা চালান করিবার যে অধিকার ছিল তাহাও হ্রাস করা হইয়াছে। অবশ্য, বিচারকর্তারা অভিজ্ঞতার দ্বারা কোনো ক্রটি পাইয়া যদি এই সকল বিধি সংশোধনের পরামর্শ দিতেন তাহা হইলেও বুঝিতাম- কিন্তু তাহা নহে- এ কেবল কর্তৃপুরুষদেরই কৃতকার্য। নূতন বিধি প্রণয়নে হাইকোর্টের এক জজ নিযুক্ত ছিলেন বটে— কিন্তু এই সংশোধনগুলি তাহার বিচার-করা-কালীন পরামর্শসভূত নহে। একদিকে আইন কড়া, অন্য দিকে দণ্ডবিধিও যদি সংকীর্ণ হয় তবে অভিযুক্তদিগের পক্ষে বড়োই সংকট। ইহা ব্রিটিশ ন্যায়নীতির বিরুদ্ধে। কারণ তাঁহাদের ন্যায়ের মূলসূত্র এই যে, ৯৯ জন অপরাধী খালাস পাইলেও ক্ষতি নাই। কিন্তু একজনও নিরপরাধ যেন দণ্ড না পায়। কর্তৃপুরুষদের ক্ষমতাবৃদ্ধির এই চেষ্টা আমাদের প্রাদেশিক শাসনেও লক্ষিত হয়। প্রজাস্বত্বসম্বন্ধীয় নূতন আইনে খাস মহল এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বহির্ভুক্ত মহলের প্রজাদের খাজানা বৃদ্ধির ক্ষমতা এক্ষণে একেবারে রেভিনু কৰ্মচারীদের হস্তে অৰ্পিত হইয়াছে। এই রেভিানু! কর্মচারীরা কর্তৃত্ববিভাগের অঙ্গ। পূর্বে এই রেভিানু! কর্মচারীদিগকে দেওয়ানীকার্যবিধি অনুসারে চলিতে হইত, এবং তঁহাদের রায়ের উপর সিভিল কোর্টে আপিল চলিবার বাধা ছিল না। নূতন নিয়ম অনুসারে তাহারাই সরাসরি ভাবে হুকুম দিবেন এবং তাহার উপরে আর আপিল চলিবে না। ইহাতে খাজনা বৃদ্ধির পথ সম্পূর্ণ অবাধ হইল। দুঃখের সহিত বলিতেছি আমাদের মধ্যে যাহারা মন্ত্রীসভায় এই আইনের বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করিয়াছিলেন জমিদারসম্প্রদায় তাহাদিগকে উপলক্ষ করিয়া কনগ্রেসের প্রতি বিমুখভােব প্রকাশ করিয়াছেন। কনগ্ৰেসপক্ষীয়দের অবস্থা এমন যে, আমাদিগকে জমিদার ও রায়ত উভয়েরই প্রতি দৃষ্টি রাখিতে হয়। যেখানে সামঞ্জস্য সম্ভব
