পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

“ኣካöሕ» উপায় নাই। ভিক্ষা করিতে গিয়া আমি নানা প্রকার লোক দেখিতে পাই- তাহাদের নানাবিধ ভাবভঙ্গি আলোচনা করি।- বিদ্বান মূর্খদের দলে দাঁড়াইয়া তাহদের মতামত শুনি, মনে মনে • হাসি কখনো বা কঁদি, আবার বাড়ি আসিয়া সেই সব কথা লিখি। এইরূপে কোনোপ্রকারে সময় কটাই। আমি এখন খুব স্বাধীন, অথচ স্বাধীনতায় সুখ পাই না। মনের ভিতর যেন কেমন একটা হু হু করিতে থাকে। প্ৰাতঃকাল হইতে রাত্রিকাল পর্যন্ত আমি কত লোকই দেখিতেছি কিন্তু আমি কেমন আছি, বা আমি কে, এ কথা জিজ্ঞাসা করিবার একজনকে দেখিতে পাই না- সুতরাং লক্ষ লক্ষ মানবের মধ্যে থাকিয়াও আমার পর্ণকুটিরের বিজনতা কখনোই ভঙ্গ হয় না। আমি আপনি হাসি, আপনি কঁদি, আপনি ভাবি। মনে করিয়াছিলাম যে সংসারের শৃঙ্খল ছেদ করিয়া এই বিজন কুটিরে মনের সুখে বাস করিব। মনে করিয়াছিলাম যে, যখন কাহারো সঙ্গে আর সম্পর্ক নাই তখন কিসের উদবেগ, যখন আমি আর মোহের অধীন নহি তখন আর কিসের যাতনা, যখন মায়ায় আবদ্ধ নাহি তখন কিসের ভাবনা, কিন্তু অপরিমিত স্বাধীনতাতেই কি সুখ ?- অপরিমিত স্বাধীনতাতে রাজ্য উচ্ছিন্ন হয়, সমাজ উচ্ছঙ্খল হয়, ব্ৰহ্মাণ্ড বিপ্লবস্থ হয়। লোকে যেমন ভাবা কথায় বলিয়া থাকে- বড়ো হবে তো ছোটো হও” তেমনি স্বাধীনতা সম্বন্ধে এ কথাও বলা যাইতে পারে যে, স্বাধীন হবে তো পরাধীন হও। সমস্ত ব্ৰহ্মাণ্ডপক্ষে যে কথা স্থির সিদ্ধান্তপ্রায়, সমস্ত সমাজ, সমস্ত রাজ্যপক্ষে যে কথা স্থির সিদ্ধান্তপ্রায়, প্রত্যেক মানুষ্যের পক্ষে কেনই বা তাহা অপ্রতিষ্ঠ হইবে? সমস্ত বাহ্য প্রকৃতির নিয়ম পরাধীনতা; সমস্ত বাহ্য অন্তঃপ্রকৃতির নিয়মও পরাধীনতা; সমস্ত বাহ্য প্রকৃতি এক আকর্ষণের অধীন হইয়া চলিতেছে, সমস্ত অন্তঃপ্রকৃতিও এক আকর্ষণের অধীন হইয়া চলিতেছে। যে লোকে বলিয়াছেন বেচি নি তো তাহা কাহারো কাছে।” তিনি মিথ্যা কথা কহিয়াছেন। এরূপ গর্কিত আস্ফালন কোনো হৃদয়সম্পন্ন মানুষের কণ্ঠ হইতে নিঃসৃত হইতে পারে না। আমার হৃদয় আছে যখনই ভাবিতে পারিলাম তখন ইহাও নিশ্চয় যে সে হৃদয় পরাধীন- হয় কোনো ব্যক্তিবিশেষের নয়। কোনো বস্তুবিশেষের। কিন্তু এই প্রকার পরাধীনতা কি বিষাদের ? এই পরাধীনতার শৃঙ্খল কি মানুষ মাকড়শার মতো আপনা হইতেই উদগত করিয়া আপনিই তাহাতে বিজড়িত হইতে চাহে না? এই পরাধীনতার বীজ মানবহৃদয়ে নিহিত থাকিলেও মানুষে আপনি কি প্ৰাণ পর্যন্ত পণ করিয়া তাহা অঙ্কুরিত করিতে- তাহা বৃক্ষে পরিণত করিতে চাহে না? পরিণামে সেই বৃক্ষে বিষময় ফলই উৎপন্ন হােক আর সুধাময় ফলই উৎপন্ন হােক, সে বৃক্ষকে ফলিত করিতে কি মানুষে কোনো প্রকার ত্যাগ স্বীকার করিতে শিথিলপ্ৰযত্ন হয় ? মানবহৃদয়ের ইতিবৃত্ত পড়িলে কখনোই তাহা বোধ হইবে না। কিন্তু কিসের ' মোহে মুগ্ধ হইয়া মানুষে এইরূপ স্ব-নির্মিত তরঙ্গে তরঙ্গিত হইতে থাকে? সে কেবল কল্পনার মোহে! মহাকবি শেকসপিয়র বলিয়াছেন বটে যে, কবি প্রণয়ী আর উন্মাদগ্ৰস্ত ইহারাই কল্পনাপ্রধান, কিন্তু প্রকৃত প্ৰস্তাবে বাহ্যপ্রকৃতি যেমন এক মাধ্যাকর্ষণ শক্তিতে পরিচালিত হইতেছে, মানবহৃদয়ও সেইপ্রকার কেবল কল্পনা-প্রভাবেই পরিচালিত হইতেছে। ম্যাডেগ্যাস্কর দ্বীপের অসভ্য জাতিরা যখন তাহাদের বিকটি-দর্শন প্রস্তরময় দেবমূর্তির সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া কাতর হৃদয়ে বর প্রার্থনা করে, হিন্দুরা যখন বিজয়া-দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জন করিয়া ভগ্নহৃদয় হয়, খৃস্টানেরা যখন কুমারীপুত্র যিশুখৃস্টকে আপনাদের পাপের ভার বহন করিতে প্রার্থনা করে, তখন কি কল্পনার মোহন প্রভাব প্রতীত হয় না? ধনোেপার্জন, বিদ্যাশিক্ষা, পুত্রপালন, এ সকলেরই গভীরতম মূল প্রদেশে কল্পনা-শক্তিই প্রচ্ছন্ন ভাবে বিরাজিত থাকে। কেহ কেহ বলিতে পারেন যে, এ-সকল কৰ্যে আশাই আমাদিগকে প্রবর্তিত করে, কিন্তু যদি আশানুরূপ দূরবীক্ষণ যন্ত্রের কাচ কল্পনার স্বারা সুমজিত ও সূরাজিত না হইত, তাহা হইলে আশার উত্তেজনায় কেহই উত্তেজিত হইত না। কল্পনার মহান প্রভাব এখানেই ক্ষান্ত নহে, শুদ্ধ যে আমরা ইহার প্রভাবে সুন্দর সামগ্ৰীকে