পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/১০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রতাপ রায় তাই দেখিছে শুধু কাশীর বৃথা মাথা নাড়া— স্বরের পরে স্বর ফিরিয়া যায়, হৃদয়ে নাহি পায় সাড়া। থামিল গান যবে, ক্ষণেক-তরে বিরাম মাগে কাশীনাথ, বরজলাল-পানে প্রতাপ রায় হাসিয়া করে আঁখিপাত । কানের কাছে তার রাখিয়া মুখ কহিল, ওস্তাদ জী, গানের মতো গান শুনায়ে দাও, এরে কি গান বলে ! ছি ! এ যেন পাখি লয়ে বিবিধ ছলে শিকারী বিড়ালের খেলা । সেকালে গান ছিল, একালে হায় গানের বড়ো অবহেলা । বরজলাল বুড়া শুক্লকেশ, শুভ্র উষ্ণীষ শিরে, বিনতি করি সবে সভার মাঝে আসন নিল ধীরে ধীরে । শিরা-বাহির-করা শীর্ণ করে তুলিয়া নিল তানপুর, ধরিল নতশিরে নয়ন মুদি ইমনকল্যাণ স্বর। । কঁাপিয়া ক্ষীণ স্বর মরিয়া যায় বৃহৎ সভাগৃহকোণে, ক্ষুদ্র পাখি যথা ঝড়ের মাঝে উড়িতে নারে প্রাণপণে । বসিয়া বাম পাশে প্রতাপ রায় দিতেছে শত উৎসাহ— ‘আহাহা, বাহ বাহা কহিছে কানে, গলা ছাড়িয়া গান গাহ। সভার লোকে সবে অন্যমন— কেহ বা কানাকানি করে, কেহ বা তোলে হাই, কেহ বা ঢোলে, কেহ বা চলে যায় ঘরে । ‘ওরে রে আয় লয়ে তামাকু পানী ভূত্যে ডাকি কেহ কয়। সঘনে পাখা নাড়ি কেহ বা বলে, ‘গরম আজি অতিশয়।’ করিছে আনাগোনা ব্যস্ত লোক, ক্ষণেক নাহি রহে চুপ। নীরব ছিল সভা, ক্রমশ সেথা শব্দ ওঠে শতরূপ। বুড়ার গান তাহে ডুবিয়া যায়, তুফান-মাঝে ক্ষীণ তরী— কেবল দেখা যায় তানপুরায় আঙুল কাপে থরথরি। হৃদয়ে যেথা হতে গানের সুর উচ্ছসি উঠে নিজ সুখে হেলার কলরব শিলার মতে চাপে সে উৎসের মুখে । কোথায় গান আর কোথায় প্রাণ দু দিকে ধায় দুই জনে, তবুও রাখিবারে প্রভূর মান বরজ গায় প্রাণপণে।