পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চতুরঙ্গ । 8 ו(? S মধ্যে এক তক্তপোশ, তার উপরে স্বামীজির বিছানা পাতা । সেই বিছানার এক পাশে বসাটা অসংগত মনে করি না— কিন্তু কী জানি-— সে ঘটিয়া উঠিল না, দরজার কাছে দাড়াইয়া রহিলাম। দেখিলাম, স্বামী জানেন আমি রায়চাদ-প্রেমৰ্চাদের বৃত্তিওয়ালা। বলিলেন, বাবা, ডুবুরি মুক্ত তুলিতে সমুদ্রের তলায় গিয়া পৌছায়, কিন্তু সেখানেই যদি টিকিয়া যায় তবে রক্ষা নাই— মুক্তির জন্য তাকে উপরে উঠিয়া ইপি ছাড়িতে হয়। বাচিতে চাও যদি বাপু, তবে এবার বিদ্যাসমুদ্রের তলা হইতে ডাঙার উপরে উঠতে হইবে। প্রেমচাঁদ-রায়চাদের বৃত্তি তো পাইয়াছ এবার প্রেমচাঁদ-রায়চাদের নিবৃত্তিটা একবার দেখো । শচীশ তামাক সাজিয়া তার হাতে দিয়া তার পায়ের দিকে মাটির উপরে বসিল । স্বামী তখনই শচীশের দিকে র্তার পা ছড়াইয়া দিলেন। শচীশ ধীরে ধীরে তার পায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল । দেখিয়া আমার মনে এতবড়ো একটা আঘাত বাজিল যে ঘরে থাকিতে পারিলাম না। বুঝিয়াছিলাম, আমাকে বিশেষ করিয়া ঘ দিবার জন্যই শচীশকে দিয়া এই তামাক সাজানো, এই পা-টেপানো । স্বামী বিশ্রাম করিতে লাগিলেন, অভ্যাগত সকলের খিচুড়ি খাওয়া হইল। বেলা পাচটা হইতে আবার কীর্তন শুরু হইয়া রাত্রি দশটা পর্যন্ত চলিল । রাত্রে শচীশকে নিরালা পাইয়া বলিলাম, শচীশ, জন্মকাল হইতে তুমি মুক্তির মধ্যে মাহুষ, আজ তুমি এ কী বন্ধনে নিজেকে জড়াইলে ? জ্যাঠামশায়ের মৃত্যু কি এতবড়ো মৃত্যু ? يد আমার শ্ৰীবিলাস নামের প্রথম দুটো অক্ষরকে উন্টাইয়া দিয়া শচীশ কিছু বা স্নেহের কৌতুকে কিছু বা আমার চেহারার গুণে আমাকে বিশ্ৰী বলিয়া ডাকিত। সে বলিল, বিশ্ৰী, জ্যাঠামশায় যখন বাচিয়া ছিলেন তখন তিনি আমাকে জীবনের কাজের ক্ষেত্রে মুক্তি দিয়াছিলেন, ছোটো ছেলে যেমন মুক্তি পায় খেলার আঙিনায় ; জ্যাঠামশায়ের মৃত্যুর পরে তিনি আমাকে মুক্তি দিয়াছেন রসের সমুদ্রে, ছোটাে ছেলে যেমন মুক্তি পায় মায়ের কোলে । দিনের বেলাকার সে মুক্তি তো ভোগ করিয়াছি, এখন রাতের বেলাকার এ মুক্তিই বা ছাড়ি কেন ? এ দুটো ব্যাপারই সেই আমার এক জ্যাঠামশায়েরই কাও এ তুমি নিশ্চয় জানিয়ে। আমি বলিলাম, যাই বল, এই তামাক-সাজানো পা-টেপানে এ-সমস্ত উপসর্গ জ্যাঠমশায়ের ছিল না— মুক্তির এ চেহারা নয়। -*.