পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চতুরঙ্গ 8&A ওই রূপকে তুমি বিশ্বের সমস্তের চেয়ে বড়ো করিয়া দেখিতেছ সময় গেলেই সেই তৃষ্ণাকে সুদ্ধ একেবারে লোপ করিয়া দিবে। যেখানে মিথ্যার ফঁাদ এমন স্পষ্ট করিয়া পাত, দরকার কী সেখানে বাহাদুরি করিতে যাওয়া ? আমি বলিলাম, তোমার কথা সবই মানিতেছি ভাই, কিন্তু আমি এই বলি, প্রকৃতির বিশ্বজোড়া ফাদ আমি নিজের হাতে পাতি নাই এবং সেটাকে সম্পূর্ণ পাশ কাটাইয়া চলি এমন জায়গা আমি জানি না । ইহাকে বেকবুল করা যখন আমাদের হাতে নাই তখন সাধনা তাহাকেই বলি, যাহাতে প্রকৃতিকে মানিয়া প্রকৃতির উপরে উঠিতে পারা যায়। যাই বল ভাই, আমরা সে রাস্তায় চলিতেছি না, তাই সত্যকে আধখানা ছাটিয়া ফেলিবার জন্য এত বেশি ছট্‌ফট্‌ করিয়া মরি। শচীশ বলিল, তুমি কী রকম সাধন চালাইতে চাও আর-একটু স্পষ্ট করিয়া বলে। শুনি । আমি বলিলাম, প্রকৃতির স্রোতের ভিতর দিয়াই আমাদিগকে জীবনতরী বাহয় চলিতে হইবে। আমাদের সমস্যা এ নয় যে, স্রোতটাকে কী করিয়া বাদ দিব ; সমস্তা এই যে, তরী কী হইলে ডুবিবে না, চলিবে। সেই জন্যই হালের দরকার। শচীশ বলিল, তোমরা গুরু মান না বলিয়াই জান না যে, গুরুই আমাদের সেই হাল । সাধনাকে নিজের খেয়ালমতে গড়িতে চাও ? শেষকালে মরিবে । এই কথা বলিয়া শচীশ গুরুর ঘরে গেল এবং তার পায়ের কাছে বসিয়া পা টিপিতে শুরু করিয়া দিল। সেইদিন শচীশ গুরুর জন্য তামাক সাজিয়া দিয়া তার কাছে প্রকৃতির নামে নালিশ রুজু করিল। এক দিনের তামাকে কথাটা শেষ হইল না। অনেক দিন ধরিয়া গুরু অনেক চিন্ত৷ করিলেন। দামিনীকে লইয়া তিনি বিস্তর ভুগিয়াছেন। এখন দেখিতেছেন, এই একটিমাত্র মেয়ে তার ভক্তদের একটানা ভক্তিস্রোতের মাঝখানে বেশ একটি ঘৃণির স্বষ্টি করিয়া তুলিয়াছে। কিন্তু, শিবতোষ বাড়ি-ঘর-সম্পত্তি-সমেত দামিনীকে তার হাতে এমন করিয়া সপিয়া গেছে যে, তাকে কোথায় সরাইবেন তা ভাবিয়া পাওয়া কঠিন । তার চেয়ে কঠিন এই যে, গুরু দামিনীকে ভয় করেন। এ দিকে শচীশ উৎসাহের মাত্র দ্বিগুণ চৌগুণ চড়াইয় এবং ঘন ঘন গুরুর প৷ টিপিয়া, তামাক সাজিয়া, কিছুতেই এ কথা ভুলিতে পারিল না যে, প্রকৃতি তার সাধনার রাস্তায় দিব্য করিয়া আডডা গাড়িয়া বসিয়াছে। একদিন পাড়ায় গোবিন্দজির মন্দিরে একদল নামজাদ বিদেশী কীর্তনওয়ালার কীর্তন চলিতেছিল। পালা শেষ হইতে অনেক রাত হইবে। আমি গোড়ার দিকেই