পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

જન્મ রবীন্দ্র-রচনাবলী বন্ধ করিতে করিতে দেখিল, শচীশ বিছানা হইতে উঠিয়া পড়িয়াছে। মুহূর্তকালের জন্য যেন দ্বিধা করিয়া তার পরে বেগে ঘর হইতে সে বাহির হইয়া গেল। বিদ্যুৎ চমক দিতে লাগিল এবং একটা চাপা বজ্র গরগর করিয়া উঠিল । দামিনী অনেক ক্ষণ নিজের ঘরের চৌকাঠের পরে বসিয়া রহিল। কেহই ফিরিয়া আসিল না । দমক হাওয়ার অধৈর্য ক্রমেই বাড়িয়া চলিল । দামিনী আর থাকিতে পারিল না, বাহির হইয়া পড়িল । বাতাসে দাড়ানো দায় । মনে হইল, দেবতার পেয়াদাগুলা তাকে ভৎসনা করিতে করিতে ঠেলা দিয়া লইয়া চলিয়াছে। অন্ধকার আজ সচল হইয়া উঠিল । বৃষ্টির জল আকাশের সমস্ত ফাক ভরাট করিবার জন্য প্রাণপণে লাগিয়াছে। এমনি করিয়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ডুবাইয়া কাদিতে পারিলে দামিনী বাচিত । হঠাৎ একটা বিদ্যুৎ অন্ধকারটাকে আকাশের এক ধার হইতে আর-এক ধার পর্যন্ত পড় পড়, শব্দ করিয়া ছিড়িয়া ফেলিল। সেই ক্ষণিক আলোকে দামিনী দেখিতে পাইল, শচীশ নদীর ধারে দাড়াইয়। দামিনী প্রাণপণ শক্তিতে উঠিয়া পড়িয়া এক দৌড়ে একেবারে তার পায়ের কাছে আসিয়া পড়িল ; বাতাসের চীংকারশবকে হার মানাইয়া বলিয়া উঠিল, এই তোমার পা ছুইয়া বলিতেছি, তোমার কাছে অপরাধ করি নাই, কেন তবে আমাকে এমন করিয়া শাস্তি দিতেছ ? শচীশ চুপ করিয়া দাড়াইয়া রহিল। দামিনী বলিল, আমাকে লাথি মারিয়া নদীর মধ্যে ফেলিয়া দিতে চাও তো ফেলিয়া দাও, কিন্তু তুমি ঘরে চলো । শচীশ বাড়িতে ফিরিয়া আসিল । ভিতরে ঢুকিয়াই বলিল, র্যাকে আমি খুজিতেছি তাকে আমার বড়ো দরকার—আর-কিছুতেই আমার দরকার নাই। দামিনী, তুমি আমাকে দয়া করে, তুমি আমাকে ত্যাগ করিয়া যাও । দামিনী একটু ক্ষণ চুপ করিয়া দাড়াইয়া রহিল । তার পরে বলিল, তাই আমি যাইব । (i. পরে আমি দামিনীর কাছে আগাগোড়া সকল কথাই শুনিয়াছি, কিন্তু সেদিন কিছুই জানিতাম না। তাই বিছানা হইতে যখন দেখিলাম এরা দুজনে সামনের বারান্দা দিয়া আপন আপন ঘরের দিকে গেল তখন মনে হইল, আমার দুর্ভাগ্য বুকের উপর চাপিয়া বসিয়া আমার গলা টিপিয়া ধরিতেছে। ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া বসিলাম, সে রাত্রে আমার ঘুম হইল না।