পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

* রবীন্দ্র-রচনাবলী । স্বষ্টিকর্তার সেই আনন্দের উচ্চহাস্ত এবারকার ফাঙ্কনে এই ভাড়াটে বাড়ির দেয়াল-কটার মধ্যে বারবার ধ্বনিয়া ধ্বনিয়া উঠিল। | আমি যে একটা-কিছু দামিনী এতদিন সে কথা লক্ষ্য করিবার সময় পায় নাই ; বোধ করি আর-কোনো দিক হইতে তার চোখে বেশি একটা আলে| পড়িয়াছিল । এবারে তার সমস্ত জগৎ সংকীর্ণ হইয়া সেইটুকুতে আসিয়া ঠেকিল যেখানে আমিই কেবল একলা। কাজেই আমাকে সম্পূর্ণ চোখ মেলিয়া দেখা ছাড়া আর উপায় ছিল না। আমার ভাগ্য ভালো, তাই ঠিক এই সময়টাতেই দামিনী আমাকে যেন প্রথম দেখিল । | অনেক নদীপৰ্বতে সমুদ্রতীরে দামিনীর পাশে পাশে ফিরিয়াছি, সঙ্গে সঙ্গে খোল-করতালের ঝড়ে রসের তানে বাতাসে আগুন লাগিয়াছে। ‘তোমার চরণে আমার পরানে লাগিল প্রেমের ফাসি’ এই পদের শিখা নূতন নূতন আখরে স্ফুলিঙ্গ বর্ষণ করিয়াছে। তবু পর্দা পুড়িয়া যায় নাই । কিন্তু, কলিকাতার এই গলিতে এ কী হইল ! ঘেঁষাৰ্ঘেষি ওই বাড়িগুলো চারি দিকে যেন পারিজাতের ফুলের মতো ফুটিয়া উঠিল। বিধাতা তার বাহাদুরি দেখাইলেন বটে ! এই ইটকাঠগুলোকে তিনি তার গানের স্বর করিয়া তুলিলেন। আর, আমার মতে সামান্য মানুষের উপর তিনি কী পরশমণি ছোয়াইয়া দিলেন আমি এক মুহূর্তে অসামান্য হইয়া উঠিলাম। যখন আড়াল থাকে তখন অনস্তকালের ব্যবধান, যখন আড়াল ভাঙে তখন সে এক নিমেষের পাল্লা । আর দেরি হইল না । দামিনী বলিল, আমি একটা স্বপ্নের মধ্যে ছিলাম, কেবল এই একটা ধাক্কার অপেক্ষ ছিল । আমার সেই-তুমি আর এই-তুমির মাঝখানে ওটা কেবল একটা ঘোর আসিয়াছিল। আমার গুরুকে আমি বারবার প্রণাম করি, তিনি আমার এই ঘোর ভাঙাইয়া দিয়াছেন। আমি দামিনীকে বলিলাম, দামিনী, তুমি অত করিয়া আমার মুখের দিকে চাহিয়ে না। বিধাতার এই স্বষ্টিটা যে স্থদুখ নয় সে তুমি পূর্বে একদিন যখন আবিষ্কার করিয়াছিলে তখন সহিয়াছিলাম, কিন্তু এখন সহ করা ভারী শক্ত হইবে । 曾 দামিনী কহিল, বিধাতার ওই কৃষ্টিটা যে সুদৃশু, আমি সেইটেই আবিষ্কার করিতেছি । আমি কহিলাম, ইতিহাসে তোমার নাম থাকিবে । উত্তরমেরুর মাঝখানটাতে যে দুঃসাহসিক আপনার নিশান গাড়িবে তার কীর্তিও এর কাছে তুচ্ছ। এ তে দুঃসাধ্যসাধন নয়, এ যে অসাধ্যসাধন ।