পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মুক্তধারা \OON মন্ত্রী । ক্ষমা করবেন, মহারাজ। খন্তা-কাদাল হাতে মাটি-পাথরের সঙ্গে পালোয়ানি আমাদের কাজ নয়। রাষ্ট্রনীতি আমাদের অস্ত্ৰ, মানুষের মন নিয়ে আমাদের কারবার। যুবরাজকে শিবতরাইয়ের শাসনভার দেবার মন্ত্রণা আমিই দিয়েছিলুম তাতে যে বাধ বাধা হতে পারত সে কম নয় । রণজিৎ । তাতে ফল হল কী ? দুবছর খাজনা বাকি। এমনতরো দুৰ্ভিক্ষ তো সেখানে বারে বারেই ঘটে, তাই বলে রাজার প্রাপ্য তো বন্ধ হয় না। মন্ত্রী । খাজনার চেয়ে দুর্মুল্য জিনিস আদায় হচ্ছিল, এমন সময় তীকে ফিরে আসতে আদেশ করলেন। রাজকার্যে ছোটােদের অবজ্ঞা করতে নেই। মনে রাখবেন, যখন অসহ্য হয় তখন দুঃখের জোরে ছোটােরা বড়োদের ছড়িয়ে বড়ো হয়ে ওঠে । রণজিৎ । তোমার মন্ত্রণার সুর ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। কতবার বলেছ উপরে চড়ে বসে নীচে চাপ দেওয়া সহজ, আর বিদেশী প্রজাদের সেই চাপে রাখাই রাজনীতি। এ কথা বল নি ? মন্ত্রী ৷ বলেছিলুম। তখন অবস্থা অন্যরকম ছিল, আমার মন্ত্রণা সময়োচিত হয়েছিল। কিন্তু (ԶՀթN রণজিৎ । যুবরাজকে শিবতরাইয়ে পাঠাবার ইচ্ছে আমার একেবারেই ছিল না। মন্ত্রী । কেন মহারাজ ? রণজিৎ । যে প্রজারা দূরের লোক, তাদের কাছে গিয়ে ঘেঁষাৰ্ঘেষি করলে তাদের ভয় ভেঙে যায়। তি দিয়ে পাওয়া যায় আপন লোককে, পরকে পাওয়া যায়। ভয় জাগিয়ে রেখে | মন্ত্রী। মহারাজ, যুবরাজকে শিবতরাইয়ে পাঠাবার আসল কারণটা ভুলছেন। কিছুদিন থেকে তীর মন অত্যন্ত উতলা দেখা গিয়েছিল। আমাদের সন্দেহ হল যে তিনি হয়তো কোনো সূত্রে জানতে পেরেছেন যে তার জন্ম রাজবাড়িতে নয়, তাকে মুক্তধারার ঝরনাতলা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া গেছে। তাই তাকে ভুলিয়ে রাখবার জন্যে— রণজিৎ । তা তো জানি- ইদানীং ও যে প্ৰায় রাত্রে একলা ঝরনাতলায় গিয়ে শুয়ে থাকত । খবর পেয়ে একদিন রাত্রে সেখানে গেলুম, ওকে জিজ্ঞাসা করলুম, “কী হয়েছে অভিজিৎ, এখানে কেন ? ও বললে, “এই জলের শব্দে আমি আমার মাতৃভাষা শুনতে পাই ।” মন্ত্রী। আমি তীকে জিজ্ঞাসা করেছিলুম, “তোমার কী হয়েছে। যুবরাজ ? রাজবাড়িতে আজকাল তোমাকে প্রায় দেখতে পাই নে কেন ? তিনি বললেন, “আমি পৃথিবীতে এসেছি পথ কাটবার জন্যে, এই খবর আমার কাছে এসে পৌচেছে।” রণজিৎ । ঐ ছেলের যে রাজচক্রবর্তীর লক্ষণ আছে। এ বিশ্বাস আমার ভেঙে যাচ্ছে । মন্ত্রী । যিনি এই দৈবলক্ষণের কথা বলেছিলেন তিনি যে মহারাজের গুরুর গুরু অভিরামস্বামী । রণজিৎ । ভুল করেছেন তিনি। ওকে নিয়ে কেবলই আমার ক্ষতি হচ্ছে। শিবতরাইয়ের পশম যাতে বিদেশের হাটে বেরিয়ে না যায়। এইজন্যে পিতামহদের আমল থেকে নন্দিসংকটের পথ আটক করা আছে। সেই পথটাই অভিজিৎ কেটে দিলে। উত্তরকুটের অন্নবস্ত্ৰ দুমুল্য হয়ে উঠবে যে | মন্ত্রী । অল্প বয়স কিনা । যুবরাজ কেবল শিবতরাইয়ের দিক থেকেই— রণজিৎ । কিন্তু এ যে নিজের লোকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। শিবতরাইয়ের ঐ যে ধনঞ্জয় বৈরাগীটা প্রজাদের খেপিয়ে বেড়ায়, এর মধ্যে নিশ্চয় সেও আছে। এবার কঠিসুদ্ধ তার কণ্ঠটা চেপে ধরতে হবে । তাকে বন্দী করা চাই । মন্ত্রী । মহারাজের ইচ্ছার প্রতিবাদ করতে সাহস করি নে। কিন্তু জানেন তো, এমন-সব দুৰ্যোগ আছে যাকে আটকে রাখার চেয়ে ছাড়া রাখাই নিরাপদ । , রণজিৎ । আচ্ছা, সেজন্যে চিন্তা কোরো না । মন্ত্রী । আমি চিন্তা করি না, মহারাজকেই চিন্তা করতে বলি । প্রতিহারীর প্রবেশ প্রতিহারী। মোহনগড়ের খুড়া মহারাজ বিশ্বজিৎ অদূরে। [প্ৰস্থান