পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চার অধ্যায় 8 ᎤᏔ) পেনশনভোগী মন্ত্রিপদপ্রার্থীর কলম দিয়ে বেরোলে রাজদরবারে তার মোক্ষলাভ হত। বটু যদি তোমার সঙ্গে না লগত তা হলে ঐ খােতাখানাই তোমার গ্রহশ্বস্ত্যয়নের কাজ করত ।” “বলেন কী ? সবটাই পড়েছেন ?” “পড়েছি বৈকি। কী বলব বাবাজি, আমার যদি মেয়ে থাকত আর এমন লেখা যদি সে তোমার কলম থেকে বের করতে পারত তা হলে সার্থক মানতুম আপনি পিতৃপদকে। সত্যি কথা বলি, “আপনার এই ব্যাবসার কথা দলের সবাই জানে ?” “ কেউ না ।” “মাস্টারমশায় ?” “বুদ্ধিমান, আন্দাজ করতে পারেন। কিন্তু আমাকে জিজ্ঞাসাও করেন নি, শোনেন নি আমার মুখ থেকে ৷” “আমাকে বললেন যে !” “এইটেই আশ্চৰ্য্য কথা । আমার মতো সন্দেহজীবী মানুষ কাউকে যদি বিশ্বাস না করতে পারে তা হলে দম আটকে মরে । আমি ভাবুক নই, বােকাও নই, তাই ডায়ারি রাখি নি, যদি রাখতুম তোমার হাতে দিতে পারলে মন খোলসা হত ।” “মাস্টারমশায়-” “মাস্টারমশায়ের কাছে খবর দেওয়া চলে। কিন্তু মন খোলা চলে না । ইন্দ্রনাথের প্রধান মন্ত্রী আমি, কিন্তু তার সব কথা আমি যে জানি তা মনেও কোরো না | এমন কথা আছে যা আন্দাজ করতেও সাহস হয় না । আমার বিশ্বাস, আমাদের দলের যারা আপনি ঝরে পড়ে, ইন্দ্রনাথ আমার মতোই তাদের বেঁটিয়ে ফেলে পুলিসের পাশতলায় । কাজটা গৰ্হিত কিন্তু নিষ্পাপ | বলে রাখছি, একদিন ওরই বা আমারই সাহায্যে তোমার হাতে শেষ হাতকড়ি পড়বে, তখন কিছু মনে কোরো না যেন । তোমার এ-বাড়িতে আসার খবর বটুই প্ৰথম থানার কানাকানি-বিভাগে জানিয়েছে। কাজেই আমাকে টেক্কা দিতে হল, ফোটােগ্রাফ তুলে ওদের কাছে দিয়েছি। এখন কাজের কথা বলি। চব্বিশ ঘণ্টা তোমাকে সময় দিচ্ছি, তার পরেও যদি এখানে থাক তা হলে আমিই তোমাকে থানার পথে এগিয়ে দেব । এখান থেকে কোথায় যেতে হবে সবিস্তারে তার রাস্তাঘাট এই লিখে দিয়েছি- এর অক্ষর তোমার জানা আছে, তবু মুখস্থ করেই ছিড়ে ফেলো। এই দেখো ম্যাপ | রাস্তার এপাশে তোমার বাসা, ইস্কুলবাড়ির কোণের ঘরে । ঠিক সামনে পুলিসের থানা । সেখানে আছে আমার কোনো এক সম্পর্কে নাতি, রাইটরা কনস্টেবল, তাকে রাঘব বোয়াল বলি। তিনপুরুষে পশ্চিমে বাস । বাংলা পড়বার মাস্টারি পেয়েছ তুমি । সেখানে গেলেই রাঘব তোমার তোরঙ্গ ঘটবে, পকেট ঝাড়া দেবে, গুতোগাতাও দিতে পারে । সেইটোকেই ভগবানের দয়া বলে মনে কোরো । বাঙালি মাত্রই যে শ্যালকসম্প্রদায়ভুক্ত এই তত্ত্বটি রঘুবীরের হিন্দিভাষায় সর্বদাই প্রকাশ পেয়ে থাকে। তুমি তার কোনোপ্রকার রূঢ় প্রতিবাদের চেষ্টামাত্র কোরো না, প্ৰাণ থাকতে এদেশে ফিরে এসো না । বাইসকলটা রইল বাইরে। ইশারা যখনই পাবে সেই মুহুর্তে চড়ে বোসো | এসো বাবাজি, শেষ দিনের মতো কোলাকুলি করে নিই।” কোলাকুলি হয়ে গেলে চলে গেল কানাই । অতীন চুপ করে বসে রইল। তাকিয়ে দেখতে লাগল। অন্তরের দিকে। অকালে এসে পড়ল তার জীবনের শেষ অঙ্ক, যবনিকা আসন্নপতনমুখী, দীপ নিবে এসেছে। যাত্রা আরম্ভ হয়েছিল নির্মল ভোরের আলোয় ; সেখান থেকে আজ অনেক দূরে এসে পড়েছে। পথে পা বাড়াবার সময় যে পাথেয় হাতে ছিল তার কিছুই বাকি নেই ; পথের শেষভাগে নিজেকে কেবলই ঠকিয়ে খেয়েছে ; একদিন হঠাৎ পথের একটা বীকের মুখে সৌন্দর্যের যে আশ্চর্য দান নিয়ে ভাগ্যলক্ষ্মী তার সামনে দাড়িয়েছিল সে যেন অলৌকিক ; তেমন অপরিসীম ঐশ্বৰ্য প্রত্যক্ষ হবে ওর জীবনে, সে-কথা এর আগে ও কখনোই সম্ভব বলে ভাবতে পারে নি, কেবল তার কল্পরূপ দেখেছে। কাব্যে ইতিহাসে ;