পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 Ο8 রবীন্দ্র-রচনাবলী বারেবারে মনে হয়েছে দান্তে বিয়াত্রিচে নূতন জন্ম নিল ওদের দুজনের মধ্যে । সেই ঐতিহাসিক প্রেরণা ওর মনের ভিতরে কথা কয়েছে, দান্তের মতোই রাষ্ট্রীয় বিপ্লবের আবর্তের মধ্যে অতীন পড়েছিল ঝাপ দিয়ে, কিন্তু তার সত্য কোথায়, বীর্য কোথায়, গৌরব কোথায়, দেখতে দেখতে অনিবার্য বেগে যে পাকের মধ্যে ওকে টেনে নিয়ে এল সেই মুখোশপরা চুরিডাকাতি-খুনোখুনির অন্ধকারে ইতিহাসেৰ আলোকস্তম্ভ কখনো উঠবে না । আত্মার সর্বনাশ ঘটিয়ে অবশেষে আজ সে দেখছে কোনো যথার্থ ফল। নেই। এতে, নিঃসংশয় পরাভব সামনে । পরাভবেরও মূল্য আছে কিন্তু আত্মার পরাভাবের নয়, যে পরাভব টেনে আনল গোপনচারী বীভৎস বিভীষিকায়, যার অর্থ নেই, যার অন্ত নেই । দিনেব আলো স্নান হয়ে এল। ঝিঝি পোকার ডাক উঠেছে প্রাঙ্গণে, কোথায় গোরুর গাড়ি চলেছে তার আর্তস্বর শোনা যায় । হঠাৎ ঘরের মধ্যে দ্রুতপদে এসে পড়ল এলা, আত্মহত্যার জন্যে একঝোকে মানুষ জলে পড়ে যেমন ভাবে তেমনি আলুথালু অন্ধবেগে । অতীন লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠতেই তার বুকের উপর সে ঝাপিয়ে পড়ল । বাপরুদ্ধস্বরে বলতে লাগল, “অতীন, অতীন, পারলুম না থাকতে ।” অতীন ধীরে ধীরে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে সামনে সরিয়ে ধরে ওর অশ্রুসিক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বললে, “এলী, কী কাণ্ড করলে তুমি ?” সে বললে, “কিছু জানি নে, কী করেছি।” “এ ঠিকানা কেমন করে জানলে ?” এলা গভীর অভিমানে বললে, “তোমার ঠিকানা তুমি তো জানাও নি।” “যে তোমাকে জানিয়েছে সে তোমার বন্ধু নয় ।” “তাও আমি নিশ্চিত জানি কিন্তু তোমার কোনাে পথ না জানতে পারলে শূন্যে শূন্যে মন ঘুরে বেড়ায়, অসহ্য হয়ে ওঠে । শত্রুমিত্র বিচার করবার মতো অবস্থা আমার নয় । কতকাল তোমাকে দেখি, নি বলে দেখি ?” “ওটা আমার স্বাভাবিক স্পর্ধা | প্ৰচণ্ড ইচ্ছে আমাকে অজগর সাপের মতো দিনরাত পাক দিয়ে দিয়ে পিষেছিল। তবু তাকে মানতে পারলুম না। ওরা আমাকে বলে সেন্টিমেন্টাল, মনে ঠিক করে রেখেছিল সংকটের সময় প্রমাণ হবে। আমি ভিজে মাটিতেই তৈরি । ওরা ভাবতেই পারে না সেন্টিমেন্টেই আমার অমোঘশক্তি ৷” “মাস্টাবমশায়ও তা জানেন ৷” “এলী, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে এই ভূতুড়ে পাড়া সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো বাঙালি ভদ্রমহিলা এই জায়গাটার স্বরূপ নির্ধারণ করে নি।” “তার কারণ, বাংলাদেশের কোনো ভদ্রমহিলার অদৃষ্ট এতবড়ো গরজ এমন দুঃসহ হয়ে কোনােদিন প্ৰকাশ পায় নি ।” “কিন্তু এলী, আজ তুমি যে কাজ করলে সেটা অবৈধ ৷” “জানি সে-কথা, মানব আমার দুর্বলতা, তবু ভাঙব নিয়ম, শুধু নিজের হয়ে না, তোমার হয়েও । প্রতিদিন আমার মন বলেছে তুমি ডাকছ আমাকে । সাড়া দিতে পারি। নে বলে যে প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে। বলো, আমি এসেছি বলে খুশি হয়েছ!” । "এত খুশি হয়েছি যে তা প্রমাণ করবার জন্যে বিপদ স্বীকার করতে রাজি আছি।” “না না, তোমার কেন হবে বিপদ ! যা হয় তা আমার হােক | তা হলে আমি যাই অন্তু ।” “কিছুতেই না ! তুমি নিয়ম ভেঙে চলে এসেছ, আমি নিয়ম ভেঙে তোমাকে ধরে রাখব। দুজনে মিলে অপরাধ সমান করে নেওয়া যাক। নতুন বিস্ময়ের বসন্তী রঙে একদিন দেখেছিলুম তোমার ঐ