পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8&V রবীন্দ্র-রচনাবলী মুখ নত করিয়া কহিল, “প্ৰভু, আমাকে কি ডাকিয়া পঠাইয়াছেন।” “ই, তোমাকে দেখিতে পাই না কেন । আজকাল দেবসেবায় তোমার এত অবহেলা কেন।” চুপ করিয়া রহিল। “আমার কাছে তোমার মনের কথা প্ৰকাশ করিয়া বলে ।” কুসুম ঈষৎ মুখ ফিরাইয়া কহিল, “প্ৰভু, আমি পাপীয়সী, সেইজন্যই এই অবহেলা ?” সন্ন্যাসী অত্যন্ত স্নেহপূর্ণ স্বরে বলিলেন, “কুসুম, তোমার হৃদয়ে অশান্তি উপস্থিত হইয়াছে, আমি তাহা বুঝিতে পারিয়াছি।” কুসুম যেন চমকিয়া উঠিল— সে হয়তো মনে করিল, সন্ন্যাসী কতটা না জানি বুঝিয়াছেন। তাহার চোখ অল্পে অল্পে জলে ভরিয়া আসিল, সে সেইখানে বসিয়া পড়িল ; মুখে আঁচল ঢাকিয়া সোপানে সন্ন্যাসীর পায়ের কাছে বসিয়া কঁদিতে লাগিল । সন্ন্যাসী কিছুদূরে সরিয়া গিয়া কহিলেন, “তোমার অশান্তির কথা আমাকে সমস্ত ব্যক্ত করিয়া বলো, আমি তোমাকে শান্তির পথ দেখাইয়া দিব ।” কুসুম অটল ভক্তির স্বরে কহিল, কিন্তু মাঝে মাঝে থামিল, মাঝে মাঝে কথা বাধিয়া গেল— “আপনি আদেশ করেন তো অবশ্য বলিব । তবে, আমি ভালো করিয়া বলিতে পারিব না, কিন্তু আপনি বোধ করি মনে মনে সকলই জানিতেছেন। প্ৰভু, আমি একজনকে দেবতার মতো ভক্তি করিতাম, আমি তাহাকে পূজা করিতাম, সেই আনন্দে আমার হৃদয় পরিপূর্ণ হইয়া ছিল। কিন্তু একদিন রাত্রে স্বপ্নে দেখিলাম যেন তিনি আমার হৃদয়ের স্বামী, কোথায় যেন একটি বকুলবনে বসিয়া তাহার বামহস্তে আমার দক্ষিণহস্ত লইয়া আমাকে তিনি প্রেমের কথা বলিতেছেন। এ ঘটনা আমার কিছুই অসম্ভব, কিছুই আশ্চর্য মনে হইল না। স্বপ্ন ভাঙিয়া গেল, তবু স্বপ্নের ঘোর ভাঙিল না। তাহার পরদিন যখন র্তাহাকে দেখিলাম আর পূর্বের মতো দেখিলাম না। মনে সেই স্বপ্নের ছবিই উদয় হইতে লাগিল। ভয়ে দূরে পলাইলাম, কিন্তু সে ছবি আমার সঙ্গে সঙ্গে রহিল। সেই অবধি আমার হৃদয়ের অশান্তি দূর হয় না— আমার সমস্ত অন্ধকার হইয়া গেছে।” যখন কুসুম অশ্রু মুছিয়া মুছিয়া এই কথাগুলি বলিতেছিল, তখন আমি অনুভব করিতেছিলাম সন্ন্যাসী সবলে তাহার দক্ষিণ পদতল দিয়া আমার পাষাণ চাপিয়া ছিলেন । কুসুমের কথা শেষ হইলে সন্ন্যাসী বলিলেন, “যাহাকে স্বপ্ন দেখিয়াছ সে কে বলিতে হইবে।” কুসুম জোড়হাতে কহিল, “তাহা বলিতে পারিব না।” সন্ন্যাসী কহিলেন, “তোমার মঙ্গলের জন্য জিজ্ঞাসা করিতেছি, সে কে স্পষ্ট করিয়া বলো ।” কুসুম সবলে নিজের কোমল হাত দুটি পীড়ন করিয়া হাতজোড় করিয়া বলিল, “নিতান্ত সে কি বলিতেই হইবে।” সন্ন্যাসী কহিলেন, “হা, বলিতেই হইবে।” কুসুম তৎক্ষণাৎ বলিয়া উঠিল, “প্ৰভু, সে তুমি ” যেমনি তাহার নিজের কথা নিজের কানে গিয়া পৌঁছিল, অমনি সে মূৰ্ছিত হইয়া আমার কঠিন কোলে পড়িয়া গেল। সন্ন্যাসী প্রস্তরের মূর্তির মতো দাড়াইয়া রহিলেন। যখন মূৰ্ছা ভাঙিয়া কুসুম উঠিয়া বসিল, তখন সন্ন্যাসী ধীরে ধীরে কহিলেন, “তুমি আমার সকল কথাই পালন করিয়াছ ; আর-একটি কথা বলিব পালন করিতে হইবে । আমি আজই এখান হইতে চলিলাম, আমার সঙ্গে তোমার দেখা না হয়। আমাকে তোমার ভুলিতে হইবে। বলে এই সাধনা দু: কুসুম উঠিয়া দণ্ডইয়া সম্রাসীর মুখের পান চৰ্বিয় ধর স্বরে কহিল, “প্ৰভু, তাহাই "ן সন্ন্যাসী কহিলেন, “তবে আমি চলিলাম।” কুসুম আর কিছু না বলিয়া তীহাকে প্ৰণাম করিল, তাহার পায়ের ধূলা মাথায় তুলিয়া লইল । সন্ন্যাসী চলিয়া গেলেন ।