পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী সে যখন মুখ তুলিয়া ইহার মুখের দিকে চাহিবে, তখন বলি বলি করিয়া আবার যদি বলা না হয়। তখন নত শির করিয়া মুখ ফিরাইয়া অতি ধীরে ধীরে ফিরিয়া আসিবার সময় আবার যদি গায়, “তারে বলি বলি আর বলা হল না” । সমাপ্তি ও স্থায়িত্ব হয়তো কোথাও আছে, কিন্তু আমি তো দেখিতে পাই না। একটি চরণচিহ্নও তো আমি বেশিক্ষণ ধরিয়া রাখিতে পারি না। অবিশ্রাম চিহ্ন পড়িতেছে, আবার নূতন পদ আসিয়া অন্য পদের চিহ্ন মুছিয়া যাইতেছে। যে চলিয়া যায় সে তো পশ্চাতে কিছু রাখিয়া যায় না, যদি তাহার মাথার বোঝা হইতে কিছু পড়িয়া যায়, সহস্র চরণের তলে অবিশ্রাম দলিত হইয়া কিছুক্ষণেই তাহা ধূলিতে মিশাইয়া যায়। তবে এমনও দেখিয়াছি বটে, কোনাে কোনাে মহাজনের পুণ্যস্তুপের মধ্য হইতে এমন সকল অমর বীজ পড়িয়া গেছে। যাহা ধূলিতে পড়িয়া অঙ্কুরিত ও বর্ধিত হইয়া আমার পার্থে স্থায়ীরূপে বিরাজ করিতেছে, এবং নতুন পথিকদিগকে ছায়া দান করিতেছে। আমি কাহারও লক্ষ্য নহি, আমি সকলের উপায়মাত্র। আমি কাহারও গৃহ নহি, আমি সকলকে গৃহে লইয়া যাই । আমার অহরহ এই শোক, আমাকে কেহ চরণ রাখে না, আমার উপরে কেহ দাড়াইতে চাহে না। যাহাদের গৃহ সুদূরে অবস্থিত, তাহারা আমাকেই অভিশাপ দেয়, আমি যে পরম ধৈৰ্যে তাহাদিগকে গৃহের দ্বার পর্যন্ত পীেছাইয়া দিই তাহার জন্য কৃতজ্ঞতা কই পাই। গৃহে গিয়া বিরাম, গৃহে গিয়া আনন্দ, গৃহে গিয়া সুখসম্মিলন, আর আমার উপরে কেবল শ্রান্তির ভার, কেবল অনিচ্ছাকৃত শ্রম, কেবল বিচ্ছেদ । কেবল কি সুদূর হইতে, গৃহবাতায়ন হইতে, মধুর হাস্যলহরী পাখা তুলিয়া সূর্যালোকে বাহির হইয়া আমার কাছে আসিবামাত্র সচকিতে শূন্যে মিলাইয়া যাইবে । গৃহের সেই আনন্দের কণা আমি কি একটুখানি পাইব না ! কখনো কখনো তাহাও পাই । বালকবালিকার হাসিতে হাসিতে কলরব করিতে করিতে আমার কাছে আসিয়া খেলা করে। তাঁহাদের গৃহের আনন্দ তাহারা পথে লইয়া আসে। তাঁহাদের পিতার আশীৰ্বাদ মাতার স্নেহ গৃহ হইতে বাহির হইয়া পথের মধ্যে আসিয়াও যেন গৃহ রচনা করিয়া দেয়। আমার ধূলিতে তাহারা স্নেহ দিয়া যায়। আমার ধূলিকে তাহারা রাশীকৃত করে ও তাঁহাদের ছােটাে ছােটাে হাতগুলি দিয়া সেই স্তৃপকে মৃদু মৃদু আঘাত করিয়া পরম স্নেহে ঘুম পাড়াইতে চায়। বিমল হৃদয় লইয়া বসিয়া বসিয়া তাহার সহিত কথা কয় | হায় হায়, এত স্নেহ পাইয়াও সে তাহার উত্তর দিতে পারে না । ছোটাে ছোটাে কোমল পাগুলি যখন আমার উপর দিয়া চলিয়া যায়, তখন আপনাকে বড়ো কঠিন বলিয়া মনে হয় ; মনে হয় উহাদের পায়ে বাজিতেছে। কুসুমের দলের ন্যায় কোমল হইতে সাধ যায়। রাধিক বলিয়াছেন যাহা যাহা অরুণ-চরণ চলি যাতা, তাহা তঁহা ধারণী হইএমবু গাত । অরুণ-চরণগুলি এমন কঠিন ধারণী উপরে চলে কেন । কিন্তু তা যদি না চলিত, তবে বোধ করি কোথাও শ্যামল তৃণ জন্মিত না। w প্রতিদিন যাহারা নিয়মিত আমার উপরে চলে, তাহাদিগকে আমি বিশেষরূপে চিনি । তাহারা জানে না তাহাদের জন্য আমি প্রতীক্ষা করিয়া থাকি। আমি মনে মনে তাহাদের মূর্তি কল্পনা করিয়া লইয়াছি। বহুদিন হইল, এমনি একজন কে তাহার কোমল চরণ দুখানি লইয়া প্রতিদিন অপরায়ে বহুদূর হইতে আসিত— ছােটাে দুটি নূপুর রুনুঝুনু করিয়া তাহার পয়ে কাদিয়া কঁদিয়া বাজিত । বুঝি তাহার ঠোঁট-দুটি কথা কহিবার ঠোট নহে, বুঝি তাহার বড়ো বড়ো চোখ-দুটি সন্ধ্যার আকাশের মতো বড়ো স্নানভাবে মুখের দিকে চাহিয়া থাকিত। যেখানে ঐ বাধানো বটগাছের বামদিকে আমার একটি শাখা লোকালয়ের দিকে চলিয়া গেছে, সেখানে সে শান্তদেহে গাছের তলায় চুপ করিয়া দাড়াইয়া থাকিত । আর-একজন কে দিনের কাজ সমাপন করিয়া অন্যমনে গান গাহিতে গাহিতে সেই সময়ে লোকালয়ের দিকে চলিয়া যাইত। সে বােধ করি, কোনাে দিকে চাহিত না, কোনােখানে দাড়াইত না