পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

邻甄邻两 8ᏬᏛ আত্মীয়ের কাধের উপর চড়িয়া কান্না জুড়িয়া দিয়াছে। এমন কত জায়গায় কত কলরব উঠিয়াছে তাহার ঠিকানা নাই। হঠাৎ নহবত বাজিয়া উঠিল । সমস্ত কোলাহল ভাসাইয়া দিয়া জয় জয় শব্দে আকাশ প্লাবিত হইয়া গেল। কোলের ছেলে যতগুলো ছিল ভয়ে সমস্বরে কাদিয়া উঠিল— গায়ে গায়ে পাড়ায় পাড়ায় কুকুরগুলো উর্ধ্বমুখ হইয়া খেউ খেউ করিয়া ডাকিয়া উঠিল। পাখি। যেখানে যত ছিল ভয়ে গাছের ডাল ছাড়িয়া আকাশে উড়িল। কেবল গােটাকতক বুদ্ধিমান কাক সুদূরে গাম্ভারি গাছের ডালে বসিয়া দক্ষিণে ও বামে ঘাড় হেলাইয়া একাগ্রচিত্তে অনেক বিবেচনা করিতে লাগিল এবং একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হইবামাত্র তৎক্ষণাৎ অসন্দিগ্ধচিত্তে কা কা করিয়া ডাকিয়া উঠিতে লাগিল । রাজা আসিয়া সিংহাসনে বসিয়াছেন। পত্রমিত্ৰ সভাসদগণ আসিয়াছেন। রাজকুমারগণ ধনুর্বাণ হন্তে আসিয়াছেন । নিশান লইয়া নিশানধারী আসিয়াছে। ভার্ট আসিয়াছে । সৈন্যগণ পশ্চাতে কাতার দিয়া দাঁড়াইয়াছে। বাজনাদারগণ মাথা নাড়াইয়া নাচিয়া সবলে পরমোৎসাহে ঢোল পিটাইতেছে। মহা ধুম পড়িয়া গিয়াছে। পরীক্ষার সময় যখন হইল, ইশা খাঁ রাজকুমারগণকে প্রস্তুত হইতে কহিলেন । যুবরাজ হাসিয়া বলিলেন, “চলিবে না তো কী। আমার একটা ক্ষুদ্র তীর লক্ষ্যভ্ৰষ্ট হইলেও জগৎ সংসার যেমন চলিতেছিল। তেমনি চলিবে । আর যদিই বা না চলিত, তবু আমার জিতিবার কোনো সম্ভাবনা দেখিতেছি না ।” ইন্দ্ৰকুমার বলিলেন, "দাদা, তুমি যদি হার তো আমিও ইচ্ছাপূর্বক লক্ষ্যভ্রষ্ট হইব ।” যুবরাজ ইন্দ্ৰকুমারের হাত ধরিয়া কহিলেন, “না ভাই, ছেলেমানুষ করিয়ো না- ওস্তাদের নাম রাজধর বিবৰ্ণ শুষ্ক চিন্তাকুল মুখে চুপ করিয়া দাড়াইয়া রহিলেন । ইশা খা আসিয়া কহিলেন, “যুবরাজ, সময় হইয়াছে, ধনুক গ্রহণ করো।” যুবরাজ দেবতার নাম করিয়া ধনুক গ্রহণ করিলেন । প্রায় দুইশত হাত দূরে গোটা পাঁচ-ছয় কলাগাছের গুড়ি একত্র বাধিয়া স্থাপিত হইয়াছে। মাঝে একটা কচুর পাতা চোখের মতো করিয়া বসানো আছে। তাহার ঠিক মাঝখানে চোখের তারার মতো আকারে কালো চিহ্ন অঙ্কিত । সেই চিহ্নই লক্ষ্যস্থল | দর্শকেরা অর্ধচক্র আকারে মাঠ ঘেরিয়া দাড়াইয়া আছে- যে দিকে লক্ষ স্থাপিত, সে দিকে যাওয়া নিষেধ । যুবরাজ ধনুকে বাণ যোজনা করিলেন। লক্ষ্য স্থির করিলেন। বাণ নিক্ষেপ করিলেন, বাণ লক্ষ্যের । উপর দিয়া চলিয়া গেল ! ইশা খাঁ তাহার গোফসুদ্ধ দাড়িসুদ্ধ মুখ বিকৃত করিলেন, পাকা ভুরু কুঞ্চিত করিলেন । কিন্তু কিছু বলিলেন না । ইন্দ্ৰকুমার বিষঃ হইয়া এমন ভােব ধারণ করিলেন, যেন তীহাকেই লজিত করিবার জন্য দাদা ইচ্ছা করিয়া এই কীর্তিটি করিলেন। অস্থিরভাবে ধনুক নাড়িতে নাড়িতে ইশা খাকে বলিলেন, “দাদা মন দিলেই সমস্ত পারেন, কিন্তু কিছুতেই মন দেন না।” আগায় খেলে না, তার কারণ, বুদ্ধি তেমন সূক্ষ্ম নয়।” ইন্দ্ৰকুমার ভারি চটিয়া একটা উত্তর দিতে যাইতেছিলেন । ইশা খা বুঝিতে পারিয়া দ্রুত সরিয়া গিয়া রাজধারকে বলিলেন, “কুমার, এবার তুমি লক্ষ্যভেদ করো, মহারাজা দেখুন।” । রাজধর বলিলেন, “আগে দাদার হউক ৷” ইশা খাঁ রুষ্ট হইয়া কহিলেন, “এখন উত্তর করিবার সময় নয় । আমার আদেশ পালন করো ।” রাজধর চটিলেন, কিন্তু কিছু বলিলেন না। ধনুর্বাণ তুলিয়া লইলেন। লক্ষ্য স্থির করিয়া নিক্ষেপ করিলেন। তীর মাটিতে বিদ্ধ হইল। যুবরাজ রাজধারকে কহিলেন, “তোমার বাণ অনেকটা নিকটে গিয়াছে— আর-একটু হইলেই লক্ষ্য বিদ্ধ হইত।” রাজধর অম্লানবদনে কহিলেন, “লক্ষ্য তো বিদ্ধ হইয়াছে, দূর হইতে স্পষ্ট দেখা যাইতেছে না।” যুবরাজ কহিলেন, “না, তোমার দৃষ্টির ভ্রম হইয়াছে, লক্ষ্য বিদ্ধ হয় নাই।”