পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৪৩৮ | রবীন্দ্র-রচনাবলী হাজার করিয়া সৈন্য রহিল। স্থির হইল, একেবারে শত্রুবৃহের পঁাচ জায়গায় আক্রমণ করিয়া বৃহভেদ করিবার চেষ্টা করা হইবে । সর্বপ্রথম সারে ধানুকীরা রহিল, তার পরে তলোয়ার বর্শ প্রভৃতি লইয়া অন্য পদাতিকেরা রহিল এবং সর্বশেষে অশ্বারোহীরা সার বাধিয়া চলিল । আরাকানের মগ সৈন্যরা দীর্ঘ এক বঁাশবনের পশ্চাতে বৃহরচনা করিয়াছিল। প্রথম দিনের আক্রমণে কিছুই হইল না। ত্রিপুরার সৈন্য বৃহ ভেদ করিতে পারিল না। সপ্তম পরিচ্ছেদ দ্বিতীয় দিন সমস্ত দিন নিম্বফল যুদ্ধ -অবসানে রাত্রি যখন নিশীথ হইল- যখন উভয় পক্ষের সৈন্যেরা বিশ্রামলাভ করিতেছে, দুই পাহাড়ের উপর দুই শিবিরের স্থানে স্থানে কেবল এক-একটা আগুন জুলিতেছে, শৃগালের রণক্ষেত্রে ছিন্ন হস্তপদ ও মৃতদেহের মধ্যে থাকিয়া থাকিয়া দলে দলে কঁদিয়া উঠিতেছে— তখন শিবিরের দুই ক্রোশ দূরে রাজধর তাহার পাঁচ হাজার সৈন্য লইয়া সারবন্দি নীেকা বাধিয়া কর্ণফুলি নদীর উপরে নীেকার সেতু নির্মাণ করিয়াছেন। একটি মশাল নাই, শব্দ নাই, সেতুর উপর দিয়া অতিসাবধানে সৈন্য পার করিতেছেন । নীচে দিয়া যেমন অন্ধকারে নদীর স্রোত বহিয়া যাইতেছে তেমনই উপর দিয়া মানুষের স্রোত অবিচ্ছিন্ন বহিয়া যাইতেছে। নদীতে ভঁটা পডিয়াছে। পরপারের পর্বতময় দুৰ্গম পাড় দিয়া সৈন্যেরা অতিকষ্টে উঠিতেছে। রাজধরের প্রতি সৈনাধক্ষ ইশা খাঁর আদেশ ছিল যে, রাজধর রাত্ৰিযোগে তাহার সৈন্যদের লইয়া নদী বাহিয়া উত্তর দিকে যাত্ৰা করিবেন— তীরে উঠিয়া বিপক্ষ সৈন্যদের পশ্চাদ্ভাগে লুক্কায়িত থাকিবেন । প্ৰভাতে যুবরাজ ও ইন্দ্ৰকুমার সম্মুখভাগে আক্রমণ করিবেন।— বিপক্ষেরা যুদ্ধে শ্ৰান্ত হইলে পর সংকেত পাইলে রাজধার সহসা পশ্চাৎ হইতে আক্রমণ করিবেন । সেইজন্যই এত নৌকার বন্দোবস্ত হইয়াছে । কিন্তু রাজধর ইশা খাঁর আদেশ কই পালন করিলেন । তিনি তো সৈন্য লইয়া নদীর পরপারে উত্তীর্ণ হইলেন । তিনি আর-এক কৌশল অবলম্বন করিয়াছেন । কিন্তু কাহাকেও কিছু বলেন নাই। তিনি নিঃশব্দে আরাকানের রাজার শিবিরাভিমুখে যাত্রা করিয়াছেন । চতুর্দিকে পর্বত, মাঝে উপত্যক, রাজার শিবির তাহারই মাঝখানেই অবস্থিত । শিবিরে নির্ভয়ে সকলে নিদ্রিত । মাঝে মাঝে অগ্নিশিখা দেখিয়া দূর হইতে শিবিরের স্থান নির্ণয় হইতেছে। পর্বতের উপর হইতে বড়ো বড়ো বনের ভিতর দিয়া পর্বতের সর্বাঙ্গ গিয়া গাছের শিকড় ধুইয়া ঘোলা হইয়া জলধারা নামিতে থাকে, তেমনি পাচ সহস্র মানুষ, পাচ সহস্ৰ তলোয়ার, অন্ধকারের ভিতর দিয়া গাছের নীচে দিয়া সহস্র পথে আঁকিয়া বাকিয়া যেন নিম্নাভিমুখে ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। কিছু শব্দ নাই, মন্দগতি । সহসা পাচ সহস্ৰ সৈন্যের ভীষণ চীৎকার উঠিল— ক্ষুদ্র শিবির যেন বিদীর্ণ হইয়া গেল— এবং তাহার ভিতর হইতে মানুষগুলা কিলবিল করিয়া বাহির হইয়া পড়িল । কেহ মনে করিল দুঃস্বপ্ন, কেহ মনে করিল প্রেতের উৎপাত, কেহ কিছুই মনে করিতে পারিল না । রাজা বিনা রক্তপাতে বন্দী হইলেন। রাজা বলিলেন, “আমাকে বন্দী করিলে বা বধ করিলে যুদ্ধের অবসান হইবে না। আমি বন্দী হইবামাত্র সৈন্যেরা আমার ভাই হামচুপামুকে রাজা করিবে । যুদ্ধ যেমন চলিতেছিল তেমনই চলিবে । আমি বরঞ্চ পরাজয় স্বীকার করিয়া সন্ধিপত্র লিখিয়া দিই, আমার বন্ধন মোচন করিয়া দিন ।” রাজধর তাহাতেই সম্মত হইলেন । আরাকানরাজ পরাজয় স্বীকার করিয়া সন্ধিপত্র লিখিয়া দিলেন। একটি হস্তিদন্তনির্মিত মুকুট, পাঁচশত মণিপুরী ঘোড়া ও তিনটে বড়ো হাতি উপহার দিলেন, এইরূপ নানা ব্যবস্থা করিতে করিতে প্রভাত হইল- বেলা হইয়া গেল। সুদীর্ঘ রাত্রে সমস্তই ভূতের ব্যাপার বলিয়া মনে হইতেছিল, দিনের বেলা আরাকানের সৈন্যগণ আপনাদের অপমান স্পষ্ট অনুভব করিতে পারিল । চারি দিকে বড়ো বড়ো পাহাড় সূর্যালোকে সহস্রচক্ষু হইয়া তাহাদিগের দিকে তাকাইয়া নিঃশব্দে দাড়াইয়া রহিল। রাজধর আরাকানপতিকে কহিলেন, “আর বিলম্ব নয়— শীঘ্ৰ যুদ্ধ