পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

880 রবীন্দ্র-রচনাবলী । নবম পরিচ্ছেদ রাজধর যখন জয়োপহার লইয়া আসিলেন, তখন তাহার মুখে এত হাসি যে র্তাহার ছোটাে চোখ দেখাইয়া কহিলেন, “এই দেখো, যুদ্ধের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া এই পুরস্কার পাইয়াছি।” ইন্দ্ৰকুমার ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, “যুদ্ধ ? যুদ্ধ তুমি কোথায় করিলে। এ পুরস্কার তোমার নহে। এ রাজধার কহিলেন, “আমি জয় করিয়া আনিয়াছি ; এ মুকুট আমি পরিব।” যুবরাজ কহিলেন, “রাজধর ঠিক কথা বলিতেছেন, এ মুকুট রাজধরেরই প্রাপ্য।” ইশা খা চটিয়া রাজধারকে বলিলেন, “তুমি মুকুট পরিয়া দেশে যাইবে ! তুমি সৈন্যাধ্যক্ষের আদেশ লঙঘন করিয়া যুদ্ধ হইতে পালাইলে এ কলঙ্ক একটা মুকুটে ঢাকা পড়িবে না। তুমি একটা ভাঙা হাঁড়ির কানা পরিয়া দেশে যাও, তোমাকে সাজিবে ভালো ।” রাজধর বলিলেন, “খা সাহেব, এখন তো তোমার মুখে বোল ফুটিতেছে- কিন্তু আমি না থাকিলে তােমরা এতক্ষণ থাকিতে কোথায়।” : ইন্দ্ৰকুমার বলিলেন, “যেখানেই থাকি, যুদ্ধ ছাড়িয়া গর্তের মধ্যে লুকাইয়া থাকিতাম না।” যুবরাজ বলিলেন, “ইন্দ্ৰকুমার, তুমি অন্যায় বলিতেছ, সত্য কথা বলিতে কী, রাজধর না থাকিলে আজ আমাদের বিপদ হইত ।” ইন্দ্ৰকুমার বলিলেন, “রাজধর না থাকিলে আজ আমাদের কোনো বিপদ হইত না। রাজধর না থাকিলে এ মুকুট আমি যুদ্ধ করিয়া আনিতাম- রাজধর চুরি করিয়া আনিয়াছে। দাদা, এ মুকুট আনিয়া আমি তোমাকে পরাইয়া দিতাম- নিজে পরিতাম না ।” যুবরাজ মুকুট হাতে লইয়া রাজধারকে বলিলেন, “ভাই, তুমিই আজ জিতিয়ােছ। তুমি না থাকিলে অল্প সৈন্য লইয়া আমাদের কী বিপদ হইত জানি না। এ মুকুট আমি তোমাকে পরাইয়া দিতেছি।” বলিয়া রাজধরের মাথায় মুকুট পরাইয়া দিলেন। ইন্দ্ৰকুমারের বক্ষ যেন বিদীর্ণ হইয়া গেলা— তিনি রুদ্ধকণ্ঠে বলিলেন, “দাদা, রাজধর শৃগালের মতো গোপনে রাত্ৰিযোগে চুরি করিয়া এই রাজমুকুট পুরস্কার পাইল; আর আমি যে প্রাণপণে যুদ্ধ করিলাম— তোমার মুখ হইতে একটা প্রশংসার বাক্যও শুনিতে পাইলাম না। তুমি কিনা বলিলে রাজধর না থাকিলে কেহ তোমাকে বিপদ হইতে উদ্ধার করিতে পারিত না । কেন দাদা, আমি কি সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত তোমার চােখের সামনে যুদ্ধ করি নাই- আমি কি যুদ্ধ ছাড়িয়া পালাইয়া গিয়াছিলাম- আমি কি কখনো ভীরুতা দেখাইয়াছি । আমি কি শত্ৰু-সৈন্যকে ছিন্নভিন্ন করিয়া তোমার সাহায্যের জন্য আসি নাই। কী দেখিয়া তুমি বলিলে যে, তোমার পরম মেহের রাজধর ব্যতীত কেহ তোমাকে বিপদ হইতে উদ্ধার করিতে পারিত না ।” যুবরাজ একান্ত ক্ষুব্ধ হইয়া বলিলেন, “ভাই, আমি নিজের বিপদের কথা বলিতেছি না—” কথা শেষ হইতে না হইতে অভিমানে ইন্দ্ৰকুমার ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। ইশা খাঁ যুবরাজকে বলিলেন, “যুবরাজ, এ মুকুট তোমার কাহাকেও দিবার অধিকার নাই। আমি সেনাপতি, এ মুকুট আমি যাহাকে দিব তাঁহারই হইবে।” বলিয়া ইশা খারাজধরের মাথা হইতে মুকুট তুলিয়া যুবরাজের মাথায় দিতে গেলেন। যুবরাজ সরিয়া গিয়া বলিলেন, “না, এ আমি গ্ৰহণ করিতে পারি না।” ইশা খা বলিলেন, “তবে থাক। এ মুকুট কেহ পাইবে না।” বলিয়া পদাঘাতে মুকুট কর্ণফুলি নদীর জলে ফেলিয়া দিলেন। বলিলেন, “রাজধর যুদ্ধের নিয়ম লঙঘন করিয়াছেন- রাজধর শাস্তির যোগ্য ।”