পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8Q心 রবীন্দ্র-রচনাবলী হে বিশ্বযজ্ঞপ্রিাঙ্গণের উৎসব-দেবতা, আমি কে ? আজি উৎসবদিনে এই আসন গ্ৰহণ করিবার অধিকার আমার কী আছে ? জীবনের নীেকাকে আমি যে প্রতিদিন দাঁড় টানিয়া বাহিয়া চলিয়াছি, সে কি তোমার মহােৎসবের সোনার্বাধানো ঘাটে আসিয়া আজও পৌঁছিয়াছে ? তাহার বাধা কি একটি ? তাহার লক্ষ্য কি ঠিক থাকে ? প্রতিকূল তরঙ্গের আঘাত সে কি সামলাইতে পারিল ? দিনের পর দিন কোথায় সে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে ? আজ কোথা হইতে সহসা তোমার উৎসবে সকলকে আহবানের ভার লইয়া, হে অন্তর্যামিন, আমার অন্তরাত্মা তোমার সমক্ষে লজ্জিত হইতেছে। তাহাকে ক্ষমা করিয়া তুমিই আমাকে আহবান করে । একদিন নহে, প্রত্যহ তাহাকে আহবান করে । ফিরাও, ফিরাও, তাহাকে আত্মাভিমান হইতে ফিরাও । দুর্বল প্রবৃত্তির নিদারুণ অপমান হইতে তাহাকে রক্ষা করো। বুদ্ধির জটিলতার মধ্যে আর তাহাকে নিশ্বফল হইতে দিয়ে না। তাহাকে প্রতিদিন তোমার বিশ্বলোকে, তোমার আনন্দলোকে, তোমার সৌন্দর্যলোকে আকর্ষণ করিয়া তাহার চিরজীবনের সমস্ত দৈন্য চূৰ্ণ করিয়া ফেলো। যে মহাপুরুষগণ তোমার নিতোৎসবের নিমন্ত্রণে আহূত, যাহারা প্রতিদিনই নিখিললোকের সহিত তোমার আনন্দভোজে আসনগ্ৰহণ করিয়া থাকেন, তাহাকে বিনম্রনতশিরে তঁহাদের পদধূলি মাথায় তুলিয়া লাইতে দাও । তাহার মিথ্যা গর্ব, তাহার ব্যর্থ চেষ্টা, তাহার বিক্ষিপ্ত প্রবৃত্তি আজই তুমি অপসারিত করিয়া দাও— কাল হইতেই সে যেন নত হইয়া তোমার আসনের সর্বনিম্নস্থানে ধূলিতলে বসিবার অধিকারী হইতে পারে । তোমার উৎসব-সভার মহাসংগীত সেখানে কান পাতিয়া শুনা যাইবে, তোমার আনন্দ-উৎসবের রসস্রোত সেখানকার ধূলিকেও অভিষিক্ত করিবে। কিন্তু যেখানে অহংকার, যেখানে তর্ক, যেখানে বিরোধ, যেখানে খ্যাতিপ্ৰতিপত্তির জন্য প্রতিযোগিতা, যেখানে মঙ্গলকর্মও লোকে লুব্ধভাবে গর্বিতভাবে করে, যেখানে পুণ্যকর্ম অভ্যস্ত আচারমাত্রে পর্যবসিত— সেখানে সমস্ত আচ্ছন্ন, সমস্ত রুদ্ধ, সেখানে ক্ষুদ্র বৃহৎ রূপে প্রতিভাত হয়, বৃহৎ ক্ষুদ্র হইয়া পড়ে, সেখানে তোমার বিশ্বযজ্ঞোৎসবের আহবান উপহাসিত হইয়া ফিরিয়া আসে। সেখানে তোমার সূর্য আলোক দেয়। কিন্তু তোমার স্বহস্তলিখিত আলোক-লিপি লইয়া প্রবেশ করিতে পারে না, সেখানে তোমার উদার বায়ু নিশ্বাস জোগায় মাত্র, অন্তঃকরণের মধ্যে বিশ্বপ্রাণকে সমীরিত করিতে পারে না । সেই উদ্ধত কারাগারের পাষাণপ্রাসাদ হইতে তাহাকে উদ্ধার করো— তোমার উৎসব-প্রাঙ্গণের ধুলায় তাহাকে লুটাইতে দাও । জগতে কেহই তাহাকে না চিনুক, কেহই না মানুক, সে যেন এক প্রান্তে থাকিয়া তোমাকে চিনে তোমাকে মানিয়া চলে। এই সৌভাগ্য কবে তাহার ঘটিবে তাহা জানি না, কবে তুমি। তাহাকে তোমার উৎসবের অধিকারী করিবে তাহা তুমিই জান— আপাতত তাহার এই নিবেদন যে, এই প্রার্থনাটিও তাহার অন্তরে যেন যথার্থ সত্য হইয়া উঠে- সত্যকে সে যেন সত্যই চায়, অমৃতকে সে যেন মৌখিক যাচূঞাবাক্যের দ্বারা অপমান না করে। 〉○〉こ দিন ও রাত্রি সূৰ্য অস্ত গিয়াছে। অন্ধকার অবগুণ্ঠনের অন্তরালে সন্ধ্যার সীমান্তের শেষ স্বৰ্ণলেখাটুকু অন্তহিঁত হইয়াছে। রাত্রিকাল আসন্ন । এই যে দিন এবং রাত্রি প্রত্যহই আমাদের জীবনকে একবার আলোকে একবার অন্ধকারে তালে তালে আঘাত করিয়া যাইতেছে, ইহারা আমাদের চিত্তবীণায় কী রাগিণী ধ্বনিত করিয়া তুলিতেছে। এইরূপে প্রতিদিন আমাদের মধ্যে যে এক অপরূপ ছন্দ রচিত হইতেছে, তাহার মধ্যে কি কোনাে বৃহৎ অর্থ নাই ? আমরা এই যে অনন্ত গগনতলের নাড়িম্পন্দনের ন্যায় দিনরাত্রির নিয়মিত উত্থানপতনের অভিঘাতের মধ্যে বাড়িয়া উঠিতেছি, আমাদের জীবনের মধ্যে এই আলোক-অন্ধকারের নিত্য গতিবিধির একটা তাৎপর্য কি গ্রথিত হইয়া যাইতেছে না ? তটভূমির উপরে প্রতি বর্ষায় যে একটা