পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

sy রবীন্দ্র-রচনাবলী ് নববষ যে অক্ষর পুরুষকে আশ্রয় করিয়া অহােরাত্রাণার্ধমাসা মাস ঋতবঃ সম্বৎসরা ইতি বিধৃতাস্তিষ্ঠন্তি, দিন এবং রাত্রি, পক্ষ এবং মাস, ঋতু এবং সম্বৎসর বিধূত হইয়া অবস্থিতি করিতেছে, তিনি আদা নববর্ষের প্রথম প্ৰাতঃসূর্যকিরণে আমাদিগকে স্পর্শ করিলেন। এই স্পর্শের দ্বারা তিনি তাহার জ্যোতিলোকে তাহার আনন্দলোকে আমাদিগকে নববর্ষের আহবান প্রেরণ করিলেন । তিনি এখনই কহিলেন, পুত্র, আমার এই নীলাম্বরবেষ্টিত তৃণধান্যশ্যামল ধরণীতলে তোমাকে জীবন ধারণ করিতে বর দিলাম— তুমি আনন্দিত হও, তুমি বর লাভ করো। প্রান্তরের মধ্যে পুণ্যনিকেতনে নববর্ষের প্রথম নির্মল আলোকের দ্বারা আমাদের অভিষেক হইল। আমাদের নবজীবনের অভিষেক | মানবজীবনের যে মহােচ্চ সিংহাসনে বিশ্ববিধাতা আমাদিগকে বসিতে স্থান দিয়াছেন তাহা আজ আমরা নবগৌরবে অনুভব করিব। আমরা বলিব, হে ব্ৰহ্মাণ্ডপতি, এই যে অরুণরাগরক্ত নীলাকাশের তলে আমরা জাগ্রত হইলাম আমরা ধন্য। এই যে চিরপুরাতন অন্নপূর্ণ বসুন্ধরাকে আমরা দেখিতেছি আমরা ধন্য। এই যে 'গীতগন্ধবৰ্ণস্পন্দনে আন্দােলিত উঠিতেছে আমরা ধন্য । আদ্যকার প্রভাতে এই যে জ্যোতিধারা আমাদের উপর বর্ষিত হইতেছে ইহার মধ্যে তোমার অমৃত আছে, তাহা ব্যর্থ হইবে না, তাহা আমরা গ্রহণ করিব ; এই যে বৃষ্টিধীেত বিশাল পৃথিবীর বিত্তীর্ণ শ্যামলতা ইহার মধ্যে তোমার অমৃত ব্যাপ্ত হইয়া আছে, তাহা ব্যর্থ হইবে না, তাহা আমরা গ্ৰহণ করিব । এই যে নিশ্চল মহাকাশ আমাদের মস্তকের উপর তাহার স্থির হস্ত স্থাপন করিয়াছে তাহা তোমারই অমৃতভারে নিস্তব্ধ, তাহা ব্যর্থ হইবে না, তাহা আমরা গ্ৰহণ করিব । এই মহিমান্বিত জগতের আদ্যকার নববর্ষািদন আমাদের জীবনের মধ্যে যে গৌরব বহন করিয়া আনিল, এই পৃথিবীতে বাস করিবার গৌরব, আলোকে বিচরণ করিবার গৌরব, এই আকাশতলে আসীন হইবার গৌরব, তাহা যদি পরিপূর্ণভাবে চিত্তের মধ্যে গ্ৰহণ করি তবে আর বিষাদ নাই, নৈরাশ্য নাই, ভয় নাই, মৃত্যু নাই। তবে সেই ঋষিবাক্য বুঝিতে পারি— কোহােবান্যাৎ কঃ প্ৰাণ্যাৎ যাদেষ আকাশ আনন্দো ন স্যাৎ । কেই বা শরীরচেষ্টা করিত, কেই বা প্ৰাণধারণ করিত যদি এই আকাশে আনন্দ না থাকিতেন । আকাশ পরিপূর্ণ করিয়া তিনি আনন্দিত, তাই আমার হৃৎপিণ্ড স্পন্দিত, আমার রক্ত প্রবাহিত, আমার চেতনা তরঙ্গিত । তিনি আনন্দিত, তাই সূর্যােলাকের বিরাট যজ্ঞহােমে অগ্নি-উৎস উৎসারিত ; তিনি আনন্দিত, তাই পৃথিবীর সর্বাঙ্গ পরিবেষ্টন করিয়া তৃণদল সমীরণে কম্পিত হইতেছে ; তিনি আনন্দিত, তাই গ্রহে নক্ষত্রে আলোকের অনন্ত উৎসব । আমার মধ্যে তিনি আনন্দিত, তাই আমি আছি— তাই আমি গ্ৰহতারকার সহিত লোকলোকান্তরের সহিত অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত— তাহার আনন্দে আমি অমর, সমস্ত বিশ্বের সহিত আমার সমান মর্যাদা । তাহার প্রতিনিমেষের ইচ্ছাই আমাদের প্রতিমুহূর্তের অস্তিত্ব, আজ নববর্ষের দিনে এই কথা যদি উপলব্ধি করি- আমাদের মধ্যে র্তাহার অক্ষয় আনন্দ যদি স্তব্ধ গভীরভাবে অন্তরে উপভোগ করি।-- তবে সংসারের কোনাে বাহ্য ঘটনাকে আমার চেয়ে প্রবলতর মনে করিয়া অভিভূত হইব না— কারণ ঘটনাবলী তাহার সুখদুঃখ বিরহমিলন লাভক্ষতি জন্মমৃত্যু লইয়া আমাদিগকে ক্ষণে ক্ষণে স্পর্শ করে ও অপসারিত হইয়া যায়। বৃহত্তম বিপদই বা কতদিনের, মহত্তম দুঃখই বা কতখানি, দুঃসহতম বিচ্ছেদই বা আমাদের কতটুকু হরণ করে— তাহার আনন্দ থাকে ; দুঃখ সেই আনন্দেরই রহস্য, মৃত্যু সেই আনন্দেরই রহস্য | এই রহস্য ভেদ না করিতে পারি, নাই পারিলাম- আমাদের বোধ-শক্তিতে এই শাশ্বত আনন্দ এত বিপরীত আকারে এত বিবিধভাবে কেন প্রতীয়মান হইতেছে তাহা নাই জানিলামকিন্তু ইহা যদি নিশ্চয় জানি, এক মুহূর্ত সর্বত্র সেই পরিপূর্ণ আনন্দ না থাকিলে সমস্তই তৎক্ষণাৎ ছায়ার