পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ა(č সেই তপস্যাই আনন্দের অঙ্গ । সেইজন্য আর-একদিক দিয়া বলা হইয়াছে— আনন্দাদ্ধোব খদ্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে । আনন্দ হইতেই এই ভূত সকল উৎপন্ন হইয়াছে। আনন্দ ব্যতীত সৃষ্টির এতবড়ো দুঃখকে বহন করিবে কে । কোহ্যেবানাৎ কঃ প্ৰাণ্যাৎ যাদেষ আকাশ আনন্দো ন স্যাৎ । কৃষ্ণক চাষ করিয়া যে ফসল ফলাইতেছে সেই ফসলে তাহার তপস্যা যত বড়ো, তাহার আনন্দও ততখানি। সম্রাটের সাম্রাজ্যরচনা বৃহৎ দুঃখ এবং বৃহৎ আনন্দ, দেশভক্তের দেশকে প্রাণ দিয়া গড়িয়া তোলা পরম দুঃখ এবং পরম আনন্দ— জ্ঞানীর জ্ঞানলাভ এবং প্রেমিকের প্রিয়সাধনাও তাই । খৃস্টান শাস্ত্রে বলে ঈশ্বর মানবগৃহে জন্মগ্রহণ করিয়া বেদনার ভার বহন ও দুঃখের কণ্টক-কিরীটি মাথায় পরিয়াছিলেন। মানুষের সকল প্রকার পরিত্রণের একমাত্র মূল্যই সেই দুঃখ। মানুষের নিতান্ত আপন সামগ্ৰী যে দুঃখ, প্রেমের দ্বারা তাহাকে ঈশ্বরও আপন করিয়া এই দুঃখসংগমে মানুষের সঙ্গে মিলিয়াছেন— দুঃখকে অপরিসীম মুক্তিতে ও আনন্দে উত্তীর্ণ করিয়া দিয়াছেন— ইহাই খৃস্টানধর্মের মৰ্মকথা । আমাদের দেশেও কোনাে সম্প্রদায়ের সাধকেরা ঈশ্বরকে দুঃখদারুণ ভীষণ মূর্তির মধ্যেই মা বলিয়া ডাকিয়াছেন । সে-মূর্তিকে বাহাত কোথাও তাহারা মধুর ও কোমল, শোভন ও সুখকর করিবার লেশমাত্র চেষ্টা করেন নাই | সংহার-রূপকেই তাহারা জননী বলিয়া অনুভব করিতেছেন । এই সংহারের বিভীষিকার মধ্যেই তাহারা শক্তি ও শিবের সম্মিলন প্রত্যক্ষ করিবার সাধনা করেন । শক্তিতে ও ভক্তিতে যাহারা দুর্বল, তাহারাই কেবল সুখস্বাচ্ছন্দা-শোভাসম্পদের মধ্যেই ঈশ্বরের আবির্ভাবকে সত্য বলিয়া অনুভব করিতে চায়। তাহারা বলে ধনমােনই ঈশ্বরের প্রসাদ, সৌন্দৰ্যই ঈশ্বরের মূর্তি, সংসার সুখের সফলতাই ঈশ্বরের আশীর্বাদ এবং তাহাই পুণ্যের পুরস্কার । ঈশ্বরের দয়াকে তাহারা বড়োই সকরুণ বড়োই কোমলকান্ত রূপে দেখে । সেইজনাই এই সকল দুর্বলচিত্ত মুদ্রগুলি ঈশ্বরে দয়াক নেিজর লাভের মেহের ও উক্ত সঞ্চয় বলয় ক্ষুদ্র ও খণ্ডিত शों ७ी(N | কিন্তু হে ভীষণ, তোমার দয়াকে তোমার আনন্দকে কোথায় সীমাবদ্ধ করিব ? কেবল সুখে, কেবল সম্পদে, কেবল জীবনে, কেবল নিরাপদ নিরাতঙ্কতায় ? দুঃখ বিপদ মৃত্যু ও ভয়কে তোমা হইতে পৃথক করিয়া তোমার বিরুদ্ধে দাঁড় করাইয়া জানিতে হইবে ? তাহা নহে। হে পিতা, তুমিই দুঃখ তুমিই বিপদ, হে মাতা, তুমিই মৃত্যু তুমিই ভয় | তুমিই— ভয়ানাং ভয়ং ভীষণং ভীষণানাং । তুমিই— লেলিহাসে গ্রসমানঃ সমস্তাৎ লোকান সমগ্রন বদনৈৰ্জলদ্ভিঃ তেজোভিরাপূর্য জগৎ সমগ্ৰং ভাসস্তবােগ্ৰাঃ প্ৰতপন্তি বিষ্ণোঃ। সমগ্ৰ লোককে তোমার জুলৎবদনের দ্বারা গ্ৰাস করিতে করিতে লেহন করিতেছ, সমস্ত জগৎকে তেজের দ্বারা পরিপূর্ণ করিয়া, হে বিষ্ণু, তােমার উগ্ৰজ্যোতি প্রতপ্ত হইতেছে। হে রুদ্র, তোমারই দুঃখরূপ তোমারই মৃত্যুরূপ দেখিলে আমরা দুঃখ ও মৃত্যুর মোহ হইতে নিস্কৃতি পাইয়া তোমাকেই লাভ করি। নতুবা ভয়ে ভয়ে তোমার বিশ্বজগতে কাপুরুষের মতো সংকুচিত হইয়া । বেড়াইতে হয়— সত্যের নিকট নিঃসংশয়ে আপনাকে সম্পূর্ণ সমৰ্পণ করিতে পারি না। তখন দয়াময় বলিয়া ভয়ে তোমার নিকটে দয়া চাহি- তোমার কাছে তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনি— তোমার হীত হইতে আপনাকে রক্ষা করিবার জন্য তোমার কাছে ক্ৰন্দন করি । কিন্তু হে প্ৰচণ্ড, আমি তোমার কাছে সেই শক্তি প্রার্থনা করি যাহাতে তোমার দয়াকে দুর্বলভাবে নিজের আরামের নিজের ক্ষুদ্রতার উপযোগী করিয়া না কল্পনা করি— তােমাকে অসম্পূর্ণরূপে গ্ৰহণ করিয়া নিজেকে না প্ৰবঞ্চিত করি। কম্পিত হৃৎপিণ্ড লইয়া অশ্রুসিক্ত নেত্ৰে তোমাকে দয়াময় বলিয়া