পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ζ υ 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী হিতসাধন করাই সংসারীর জীবনের শেষ লক্ষ্য— ইহাই ধর্মনীতি । এই ধর্মনীতিকে প্রবলভাবে আশ্রয় করিতে গেলে সংসারকে মায়া-ছায়া বলিয়া উড়াইয়া দিলে চলে না । এই সংসারক্ষেত্রে জীবনের শেষদণ্ড পর্যন্ত পুরাদমে কাজ করিতে পারাই বীরত্ব- লাগামজোতা অবস্থাতেই মরা অর্থাৎ কাজে বিশ্রাম না দিয়াই জীবন শেষ করা ইংরেজের কাছে গৌরবের বিষয় বলিয়া গণ্য হয় । সংসার যে অনিত্য এ কথা ভুলিয়া, মৃত্যু যে নিশ্চিত এ কথা মনের মধ্যে পোষণ না করিয়া সংসারের সঙ্গে চিরন্তন-সম্বন্ধ-স্থাপনের চেষ্টা করায় যুরোপীয়জাতি একটা বিশেষ বললাভ করিয়াছে, সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই । ইহার বিপরীত অবস্থাকে ইহারা morbid অর্থাৎ রুগণ অবস্থা বলিয়া থাকে। সুতরাং ইহাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য এই যে, ছাত্ররা এমন করিয়া মানুষ হইবে, যাহাতে তাহারা শেষ পর্যন্ত প্ৰাণপণবলে সংসারের কর্মক্ষেত্রে লড়াই করিতে পারে । জীবনকে ইহারা সংগ্রাম বলিয়া জানে ; বিজ্ঞানও ইহাদিগকে এই শিক্ষা দেয় যে, জীবিকার লড়াইয়ে যাহারা জেতে, তাহারাই পৃথিবীতে টিকিয়া যায়। এক দিকে “চাইই চাই, নহিলেই নয়” মনের এই গুরুভাবকে খুব সতেজ রাখিবার জন্য ইহাদের চেষ্টা, অপর দিকে মুঠাটাও ইহারা খুব শক্ত করিতে থাকে । আটঘটি বাধিয়া রশাৱশি কফিয়া দশ আঙুল দিয়া ইহারা আটিয়া ধরিতে জানে। পৃথিবীকে কোনাে অংশেই এবং কোনোমতেই ছাড়িব না, ইহাই সবলে বলিতে বলিতে মাটি কামড়াইয়া মরিয়া যাওয়া ইহাদের পক্ষে বীরের মৃত্যু | সব জানিব, সব কাড়িব, সব রাখিব, এই প্রতিজ্ঞার সার্থকতা সাধন করিবার শিক্ষাই ইহাদের শিক্ষা । আমরা বলিয়া আসিয়াছি, গৃহীত ইব কেশেষু মৃত্যুনা ধর্মমাচরেৎ । মৃত্যু যেন চুলের বঁটি ধরিয়া আছে, এই মনে করিয়া ধর্মাচরণ করবে। যুরোপের সন্ন্যাসীরাও যে এ কথা বলে নাই, তাহা নহে এবং সংসারীকে ভয় দেখাইবার জন্য মৃত্যুর বিভীষিকাকে তাহারা সাহিত্যে চিত্রে এবং নানাস্থানে প্রত্যক্ষ করিবার চেষ্টা করিয়াছে। কিন্তু আমাদের প্রাচীন সংহিতার মধ্যে যে ভাবটা দেখা যায়, তাহার একটু বিশেষত্ব আছে । সংসারের সঙ্গে আমার সম্বন্ধের অন্ত নাই, এমন মনে করিয়া কাজ করিলে কাজ ভালো হয় কি মন্দ হয়, সে পরের কথা— কিন্তু ইহাতে সন্দেহ নাই যে, সে কথা মিথ্যা । সংসারে আমাদের সমুদয় সম্বন্ধেরই যে অবসান আছে, এতবড়ো সত্য কথা আর কিছুই নাই। প্রয়োজনের খাতিরে গালি দিয়া সীতাকে মিথ্যা বলিয়া চলাইলেও সে সমানে আপনার কাজ করিয়া যায় ; সোনার রাজদণ্ডকেই যে-রাজা চরম বলিয়া জানে, তাহারও হাত হইতে চরমে সেই রাজদণ্ড ধুলায় খসিয়া পড়ে ; লোকালয়ে প্রতিষ্ঠালাভকেই যে-ব্যক্তি একমাত্র লক্ষ্য বলিয়া জানে, সমস্ত জীবনের সমস্ত চেষ্টার শেষে তাহাকে সেই লোকালয় একলা ছাড়িয়া চলিয়া যাইতে হয় । বড়ো বড়ো কীর্তি লুপ্ত হইয়া যায় এবং বড়ো বড়ো জাতিকেও উন্নতির নাট্যমঞ্চ হইতে প্ৰদীপ নিবাইয়া দিয়া রঙ্গলীলা সমাধা করিতে হয় । এ-সব অত্যন্ত পুরাতন কথা, তবু ইহা কিছুমাত্র মিথ্যা নহে। সকল সম্বন্ধেরই অবসান হয়, কিন্তু তাই বলিয়া অবসান হইবার পূর্বে তাহাকে অস্বীকার করিলে তো চলে না। অবসানের পরে যাহা অসত্য, অবসানের পূর্বে তো তাহা সত্য । যাহা যৌ-পরিমাণে সত্য তাহাকে সেই পরিমাণে যদি না মানি তবে হয় সে আমাদিগকে কানে ধরিয়া মানাইবে, নয়তো কোনােদিন কোনােদিক দিয়া সুন্দসুদ্ধ শোধ করিয়া লইবে । ” ততদিন সে যদি পড়াটাকে যথার্থভাবে স্বীকার করিয়া লয়, তবেই পড়ার অবসানটা প্রকৃত হয়— তবেই বিদ্যালয় হইতে নিস্কৃতি তাহার পক্ষে সম্পূর্ণ হয়। যদি সে জোর করিয়া বিদ্যালয় হইতে অবসর লয়, তবে চিরদিন ধরিয়া অসম্পূর্ণ বিদ্যার ফল তাহাকে ভোগ করিতে হয়। পথ গম্যস্থান নয়, এ কথা ঠিক— পথের সমাপ্তিই আমাদের লক্ষ্য, কিন্তু আগে পথটাকে ভোগ না করিলে তাহার সমাপ্তিটাই অসম্ভব হইয়া পড়ে । 2.