পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ OV。 রবীন্দ্র-রচনাবলী বলিয়া জানি, মানুষকে তাহারই উপকরণমাত্র বলিয়া দেখিব ও সেই প্রয়ােজনসাধনকেই মানুষের সার্থকতা বলিয়া মনে করিব। এমন করিয়া দেখাতে কোনো হিত হয় না, তাহা নহে— কিন্তু সামঞ্জস্য নষ্ট হইয়া শেষকালে অহিত আসিয়া পড়ে— এবং যাহাকে তারা মনে করিয়া আকাশে উড়াই তাহা খানিকক্ষণ ঠিক তারার মতোই ভঙ্গি করে, তাহার পরে পুড়িয়া ছাই হইয়া মাটিতে পড়িয়া যায়। আমাদের দেশে একদিন মানুষকে সমস্ত প্রয়োজনের চেয়ে কিরূপ বড়ো করিয়া দেখা হইয়াছিল, তাহা সাধারণে প্রচলিত একটি চাণক্যশ্লোকেই দেখা যায়— ত্যজেদেকং কুলস্যার্থে গ্রামস্যার্থে কুলং ত্যজেং | গ্ৰামং জনপদস্যার্থে আত্মার্থে পৃথিবীং ত্যজেৎ ॥ চেয়ে ছোটাে নয়। প্রথমে মানুষের আত্মাকে এইরূপে সমস্ত দেশিক ও ক্ষণিক প্রয়োজন হইতে পৃথক করিয়া তাহাকে বিশুদ্ধ ও বৃহৎ করিয়া দেখিতে হইবে, তবেই সংসারের সমস্ত প্রয়ােজনের সঙ্গে তাহার সত্য সম্বন্ধ, জীবনের ক্ষেত্রের মধ্যে তাহার যথার্থ স্থান নির্ণয় করা সম্ভবপর হয় । আমাদের দেশে তাই করা হইয়াছিল ; শাস্ত্রকারগণ মানুষের আত্মাকে অত্যন্ত বড়ো করিয়া দেখিয়াছিলেন। মানুষের মর্যাদার কোথাও সীমা ছিল না, ব্রহ্মের মধ্যেই তাহার সমাপ্তি। আর যাহাতেই মানুষকে শেষ করিয়া দেখো, তাহাকে মিথ্যা করিয়া দেখা হয়- তাহাকে citizen করিয়া দেখো, কিন্তু কোথায় আছে৷ city আর কোথায় আছে সে, cityতে তাহার পর্যাপ্তি নহে; তাহাকে pgা করিয়া দেখে, কিন্তু দেশেই তাহার শেষ পাওয়া যায় না, দেশ তো জলবিম্ব ; সমস্ত পৃথিবীই বা কা । ভর্তৃহরি, যিনি এক সময়ে রাজা ছিলেন, তিনি বলিয়াছেন— প্রাপ্তাঃ শ্রিয়ঃ সকলকামদুঘাস্ততঃ কিং | ন্যস্তং পদং শিরসি বিদ্বিষতাং ততঃ কিম ৷ সম্পাদিতাঃ প্ৰণয়িনো বিভবৈস্ততঃ কিং | কল্পস্থিতান্তনুভূতাং তনবস্ততঃ কিম ৷ সকলকাম্যফলপ্ৰদ লক্ষ্মীকেই না-হয় লাভ করিলে, তাহাতেই বা কী ; শত্রুদের মাথার উপরেই না-হয় পা রাখিলে, তাহাতেই বা কী ; না-হয় বিভবের বলে বহু সুহৃদ সংগ্ৰহ করিলে, তাহাতেই বা কী ; দেহধারীদের দেহগুলিকে না-হয় কল্পকাল বাচাইয়া রাখিলে, তাহাতেই বা কী । অর্থাৎ এই সমস্ত কামনার বিষয়ের দ্বারা মানুষকে খাটাে করিয়া দেখিলে চলিবে না, মানুষ ইহার চেয়েও বড়ো । মানুষের সেই যে সকলের চেয়ে বড়ো সত্য, যাহা অনাদি হইতে অনন্তের অভিমুখ, তাহাকে মনে রাখিলে তবেই তাহার জীবনকে সজ্ঞানভাবে সম্পূর্ণতার পথে চালনা করিবার উপায় করা যাইতে পারে। কিন্তু মানুষকে যদি সংসারের জীব বলিয়াই মানি, তবে তাহাকে সংসারের প্রয়োজনের মধ্যেই আবদ্ধ করিয়া ছোটো করিয়া ছাটিয়া কাটিয়া লই । জীবনযাত্রার আদর্শ যুরোপের সহিত স্বতন্ত্র হইয়াছে- তাহারা জীবনের শেষমূহুর্ত পর্যন্ত খাটিয়া মর্যাকে গৌরবের বিষয় মনে করেন নাই- কর্মকেই তাহারা শেষলক্ষ্য না করিয়া কর্মের দ্বারা কর্মকে ক্ষয় করাই চরম সাধনার বিষয় বলিয়া জানিয়াছিলেন | আত্মার মুক্তিই যে প্রত্যেক মানুষের একমাত্র শ্ৰেয়, এ বিষয়ে তাহাদের সন্দেহ ছিল না । যুরোপে স্বাধীনতার গীেরব সকল সময়েই গাওয়া হইয়া থাকে। এই স্বাধীনতার অর্থ আহরণ করিবার স্বাধীনতা, ভোগ করিবার স্বাধীনতা, কাজ করিবার স্বাধীনতা । এ স্বাধীনতা বড়ো কম জিনিস নয়- এ সংসারে ইহাকে রক্ষা করিতে অনেক শক্তি এবং আয়োজন আবশ্যক হয় । কিন্তু প্ৰাচীন ভারতবর্ষ ইহার প্রতিও অবজ্ঞা করিয়া বলিয়াছিল— ততঃ কিম। এ স্বাধীনতাকে সে স্বাধীনতা