পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

( Σ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী গড়িয়া তোলা যায় ? তাহার উত্তরে আমি এই কথা বলি যে, যখন ঘরে আলো জ্বলে, তখন কি পিলসুজ, হইতে আরম্ভ করিয়া পলিতা পর্যন্ত প্রদীপের সমস্তটাই জ্বলে ? জীবনযাপনসম্বন্ধে ধৰ্মসম্বন্ধে যে-দেশের যে-কোনো আদৰ্শই থােক-না কেন, তাহা সমস্ত দেশের মুখাগ্রভাগেই উজ্জ্বলরাপে প্ৰকাশ পায় । কিন্তু পলিতার ডগািটমাত্র জ্বলাকেই সমস্ত দীপের জ্বলা বলে । তেমনি দেশের এক অং যে ভাবকে পূর্ণরূপে আয়ত্ত করেন, সমস্ত দেশেরই তাহা লাভ । বস্তুত সেই অংশটুকুমাত্রকে পূর্ণতা দিবার জন্য সমস্ত দেশকে প্রস্তুত হইতে হয়, সমস্ত সমাজকে অনুকুল হইতে হয়- ডালের আগায় ফল ধরাইতে গাছের শিকড় এবং গুড়িকে সচেষ্ট থাকিতে হয় । ভারতবর্ষে যদি এমন দিন আসে যে, আমাদের দেশের মান্যশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা সর্বোচ্চ সত্য এবং সর্বোচ্চ মঙ্গলকেই আর-সমস্ত খণ্ড প্রয়োজনের উর্ধের্ব তুলিয়া চিরজীবনের সাধনার সামগ্ৰী করিয়া রাখেন, তবে তাঁহাদের সাধনা ও সার্থকতা সমস্ত দেশের মধ্যে একটা বিশেষ গতি একটা বিশেষ শক্তি সঞ্চার করিবেই। একদিন ভারতবর্ষে ঋষির যখন ব্রহ্মের সাধনায় রত ছিলেন, তখন সমস্ত আৰ্যসমাজের মধ্যেই— রাজকার্যে যুদ্ধে বাণিজো সাহিতো শিল্পে ধৰ্মাৰ্চনায়- সর্বত্রই সেই ব্ৰহ্মের সুর বাজিয়াছিল, কর্মের মধ্যে মোক্ষের ভাব বিরাজ করিয়াছিল- ভারতবর্ষের সমস্ত সমাজস্থিতি মৈত্রেয়ীর নায় বলিতেছিল, “ যেনাহং নামৃত সাং কিমহং তেন। কুর্যম " সে বাণী চিরদিনের মতোই নীরব হইয়া গেছে এমনিই যদি আমাদের ধারণ হ? তবে আমাদের এই মৃতসমােজকে এত উপকরণ জোগাইয়া বৃথা সেবা করিয়া মরিতেছি কেন ? তবে তো এই মুহুর্তেই আপাদমস্তকে পরজাতির অনুকরণ করাই আমাদের পক্ষে শ্ৰেয়- কারণ, পরিণামহীন ব্যর্থতার বোঝা অকারণে বহিয়া পড়িয়া থাকার চেয়ে সজীবিভাবে কিছু-একটা হইয়া উঠার চেষ্টা করা ভালো ! কিন্তু এ কথা কখনোই মানিক না । আমাদের প্রকৃতি মানিবে না ! যতই দুৰ্গতি, হউক, আমাদের অন্তরতম স্থান এমনভাবে তৈরি হইয়া আছে যে, কোনো অসম্পূর্ণ অধিকারকে আমাদের মন পরমলাভ বলিয়া সায় দিতে পরিবে না ; এখনো যদি কোনো সাধক তাহার জীবনে? যন্ত্রে সংসারের সকল চাওয়া সকল পাওয়ার চেয়ে উচ্চতম সপ্তকে একটা বড়ো সুর বাজাইয়া তোলেন, সেটা আমাদের হৃদয়ের তারে তখনই প্রতিব্বংকৃত হইতে থাকে- তাহাকে আমরা ঠেকাইতে পাির না | প্ৰতাপ এবং ঐশ্বর্যের প্রতিযোগিতাকে আমরা যতবড়ো ক?ে যতবড়ো করিয়াই প্রচার করিবার চেষ্টা করিতেছি, আমরা সমস্ত মনপ্রাণ দিয়া তাহা গ্রহণ করিতে পারিতেছি না । তাহা আমাদের মনোর বহিৰ্দ্ধারে একটা গোলমাল পাকাইয়া তুলিয়াছে মাত্র ; আমাদের সমাজে আজকাল বিবাহ প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মে দেশী রোশন'চৌকির সঙ্গে সঙ্গে একইকালে গড়ের বাদ্য বাজানো হয় দেখিতে পাই । ইহাতে ংগীত ছিন্নবিচ্ছিন্ন হইয়া কেবল একটা সুরের গণ্ডগোল হইতে থাকে } এই বিষম গণ্ডগোলের ঝঞনার মধ্যে মনোযোগ দিলেই বুঝা যায় যে, রোশন'চৌকির বৈরাগাগাম্ভীৰ্যমিশ্রিত করুণ শাহানাই আমাদের উৎসবের চিরন্তন হৃদয়ের মধ্য হইতে বাজিতেছে, আর গড়ের বাদ তাহার প্রচণ্ড কাংস্যকণ্ঠ ও স্বাকীতোদর জয়ঢাকটা লইয়া কেবলমাত্ৰ ধনের অহংকার কেবলমাত্র ফ্যাশানের আড়ম্বরকে অভ্ৰভেদ করিয়া সমস্ত গভীরতর অন্তরতর সুরকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিতেছে । তাহা আমাদের মঙ্গল অনুষ্ঠানের মধ্যে একটা গৰ্বপরিপূর্ণ অসামঞ্জস্যকেই অত্যুৎকট করিয়া তুলিতেছে- তাহ। আমাদের উৎসবের চিরদিনের বেদনার সঙ্গে আপনার সুর মিলাইতেছে না । আমাদের জীবনের সকল দিকেই এমনিতরো একটা খাপছাড়া জোড়াতাড়িা ব্যাপার ঘটিতেছে । যুরোপীয় সভ্যতার প্রতাপ ও ঐশ্বর্যের আয়োজন আমাদের দৃষ্টিকে মুগ্ধ করিয়াছে ; তাহার অসংগত ক্ষীণ অনুকরণের দ্বারা আমরা আমাদের আড়ম্বর-আস্ফালনের প্রবৃত্তিকে খুব দৌড় করাইতেছি ; আমাদের দেউড়ির কাছে তাহার বড়ো জয়ঢাকটা কাঠি পিটাইয়া খুবই শব্দ করিতেছে, কিন্তু যে আমাদের অন্তঃপুরের খবর রাখে, সে জানে সেখানকার মঙ্গলশঙ্খ এই বাহ্যাড়ম্বরের ধমকে নীরব হইয়া যায় নাই, ভাড়া-করা গড়ের বাদ্য একসময় যখন গড়ের মধ্যে ফিরিয়া যায়, তখনো ঘরের এই শঙ্খ আকাশে উৎসবের মঙ্গলধ্বনি ঘোষণা করে । আমরা ইংরেজের রাষ্ট্রনীতি সমাজনীতি বাণিজ্যনীতির উপযোগিতা খুব করিয়া স্বীকার ও প্রচার