পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\O QQ@ \ যে কোনো পরিণাম নেই। সে যে রক্তেমাংসে অস্থিমজ্জায় জড়িয়ে রয়েই গেল- তার ভার যে চব্বিশঘণ্টা নাড়ীতে নাড়ীতে বহন করে বেড়াতে হবে । - যেদিন সংশয়ের ক্ৰন্দন আমাদের মধ্যে সত্য হয়ে ওঠে, সেদিন আমরা সম্প্রদায়ের মত, দর্শনের তর্ক ও শাস্ত্রের বাক্য নিয়ে আরাম পাই নে ; সেদিন আমরা এক মুহূর্তেই বুঝতে পারি প্রেম ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই- সেদিন আমাদের প্রার্থনা এই হয় যে, “ প্রেম-আলোকে প্রকাশো জগপতি হে ।” জ্ঞানের প্রকাশে আমাদের সংশয়ের সমস্ত অন্ধকার দূর হয় না। আমরা জেনেও জানি নে কখন ? যখন আমাদের মধ্যে প্রেমের প্রকাশ হয় না । একবার ভেবে দেখে-না এই পৃথিবীতে কত শত সহস্ৰ লোক আমাকে বেষ্টন করে আছে। তাদের যে জানি নে তা নয়, কিন্তু তারা আমার পক্ষে কিছুই নয়। সংসারে আমি এমন ভাবে চলি যেন এই অগণ্য লোক তাদের সুখদুঃখ নিয়ে নেই। তবে কারা আছে ? যারা আমার আত্মীয়স্বজন, আমার প্ৰিয়ব্যক্তি, তারাই অগণ্য জীবকে ছাড়িয়ে আছে। এই কয়েকটি লোকই আমার সংসার । কেননা এদেরই আমি প্রেমের আলোতে দেখেছি। এদেরই আমি কমবেশি। পরিমাণে আমার আত্মারই সমান করে দেখেছি । আমার আত্মা যে সত্য, আত্মপ্রেমে সেটা আমার কাছে একান্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে- সেই প্ৰেম যাদের মধ্যে প্রসারিত হতে পেরেছে তাদেরই আমি আত্মীয় বলে জানি— তাই তাদের সম্বন্ধে আমার কোনো সংশয় নেই, তারা আমার পক্ষে অনেকটা আমারই মতো সত্য | ঈশ্বর যে আছেন এবং সর্বত্রই আছেন এ কথাটা যে আমার জানার অভাব আছে তা নয়, কিন্তু আমি অহরহ সম্পূর্ণ এমন ভাবেই চলি যেন তিনি কোনােখানেই নেই। এর কারণ কী ? তার প্রতি আমার প্ৰেম জন্মে নি, সুতরাং তিনি থাকলেই বা কী, না থাকলেই বা কী ? তার চেয়ে আমার নিজের ঘরের অতি তুচ্ছ বস্তুও আমার কাছে বেশি করে আছে । প্ৰেম নেই বলেই তার দিকে আমাদের সমস্ত চোখ চায় না, আমাদের সমস্ত কানা যায় না, আমাদের সমস্ত মন খোলে না । এইজন্যেই যিনি সকলের চেয়ে আছেন তাকেই সকলের চেয়ে পাই নে— তাই এমন একটা অভাব জীবনে থেকে যায় যা আর কিছুতেই কোনোমতেই পোরাতে পারে না । ঈশ্বর থেকেও থাকেন না— এতবড়ো প্ৰকাণ্ড না-থাকা আমাদের পক্ষে আর কী আছে। এই না-থাকার ভারে আমরা প্রতি মুহুর্তেই মরছি। এই না-থাকার মানে আর কিছুই না, আমাদের প্রেমের অভাব। এই না-থাকারই শুষ্কতায় জগতের সমস্ত লাবণ্য মারা গেল, জীবনের সমস্ত সৌন্দর্য নষ্ট হল । যিনি আছেন তিনি নেই, এতবড়ো ক্ষতি কী দিয়ে পূরণ হবে । কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। দিনে রাত্রে এইজন্যেই যে গেলুম। সব জানি সব বুঝি, কিন্তু সমস্তই ব্যর্থ— প্রেম-আলোকে প্রকাশে জগপতি হে | ২৩ অগ্রহায়ণ ১।৩১৫ অভাব ঈশ্বরকে যে আমরা দিন রাত্রি বাদ দিয়ে চলছি তাতে আমাদের সাংসারিক ক্ষতি যদি সিকি পয়সাও হত তা হলে তখনই সতর্ক হয়ে উঠতুম। কিন্তু সে বিপদ নেই ; সূর্য আমাদের আলো দিচ্ছে, পৃথিবী আমাদের অন্ন দিচ্ছে, বৃহৎ লোকালয় তার সহস্ৰ নাড়ী দিয়ে আমাদের সহস্ৰ অভাব পূরণ করে চলেছে। তবে সংসারকে ঈশ্বরবর্জিত করে আমাদের কী অভাব হচ্ছে ? হায়, যে অভাব হচ্ছে তা যতক্ষণ না জানতে পারি। ততক্ষণ আরামে নিঃসংশয়ে থাকি এবং সচ্ছল সংসারের মধ্যে বাস করে মনে করি আমরা ঈশ্বরের বিশেষ অনুগৃহীত ব্যক্তি । কিন্তু ক্ষতিটা কী হয় তা.কেমন করে বোঝানো যেতে পারে ?