পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

( θΟ রবীন্দ্র-রচনাবলী ঠিক ওজনমত নিছক খাদ্য পদার্থ আমরা গ্ৰহণ করি তা হলে আমাদের চলে না, শরীর ব্যাধিগ্রন্ত হয়। কারণ কেবল কি আমাদের পাকশক্তি ও পাকযন্ত্র আছে ? আমাদের ত্যাগশক্তি ও ত্যাগযন্ত্র আছে— সেই শক্তি সেই যন্ত্রকেও আমাদের কাজ দিতে হবে, তবেই গ্ৰহণ-বর্জনের সামঞ্জস্য প্রণের পূর্ণতাসাধন ঘটবে। সংসারে তেমনি আমরা যে কেবলমাত্র ন্যায্যটুকু পাব, কেউ আমাদের প্রতি কোনো অবিচার করবে: না, এও বিধান নয়। সংসারে এই ন্যায়ের সঙ্গে অন্যায় মিশ্রিত থাকা আমাদের চরিত্রের পক্ষে একান্তু আবশ্যক | নিশ্বাস-প্ৰশ্বাসের ক্রিয়ার মতো আমাদের চরিত্রের এমন একটি সহজ ক্ষমতা থাকা চাই যাতে আমাদের যেটুকু প্ৰাপ্য সেটুকু অনায়াসে গ্রহণ করি এবং যেটুকু ত্যাজ্য সেটুকু বিনাক্ষোভে ত্যাগ করতে পারি। অতএব দুঃখ এবং আঘাত ন্যায্য হােক বা অন্যায্য হােক তার সংস্পর্শ থেকে নিজেকে নিঃশেঃে বঁচিয়ে চলবার অতিচেষ্টায় আমাদের মনুষ্যত্বকে দুর্বল ও ব্যাধিগ্রস্ত করে তোলে। এই ভীরুতায় শুধুমাত্র বিলাসিতার পেলাবতা ও দৌর্বল জন্মে তা নয়, যে-সমস্ত অতিবেদনশীল লোক আঘাতের ভয়ে নিজেকে আবৃত করে তাদের শুচিত নষ্ট হয়— আবরণের ভিতরে ভিতরে তাদের অনেক মলিনতা জমতে থাকে ; যতই লোকের ভয়ে তারা সেগুলো লোকচক্ষুর সামনে বের করতে না চায় ততই সেগুলো দূষিত হয়ে উঠে স্বাস্থ্যকে বিকৃত করতে থাকে। পৃথিবীর নিন্দ অবিচার দুঃখকষ্টকে যারা অবাধে অসংকোচে গ্রহণ করতে পারে তারা কেবল বলিষ্ঠ হয় তা নয়, তারা নির্মল হয়, অনাবৃত জীবনের উপর দিয়ে জগতের পূর্ণসংঘাত লেগে তাদের কলুষ ক্ষয় হয়ে যেতে থাকে। অতএব সমস্ত মনপ্রাণ নিয়ে প্রস্তুত হও— যিনি সুখকর তীকে প্ৰণাম করো এবং যিনি দুঃখকর তাকেও প্ৰণাম করো— তা হলেই স্বাস্থ্যলাভ করবে। শক্তিলাভ করবে- যিনি শিব যিনি শিবতন্ত্ৰ তাকেই প্ৰণাম করা হবে । २७ 59jश26 &७ (? उI6ों প্রতিদিন প্রাতে আমরা যে এই উপাসনা করছি যদি তার মধ্যে কিছু সত্য থাকে। তবে তার সাহায্যে আমরা প্রত্যহ অল্পে অল্পে ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। নিতান্তই প্ৰস্তুত হওয়া চাই, কারণ, সংসারের মধ্যে একটি ত্যাগের ধর্ম আছে, তার বিধান অমোঘ। সে আমাদের কোথাও দাঁড়াতে দিতে চায় না ; সে বলে, কেবলই ছাড়তে হবে এবং এগোতে হবে। এমন কোথাও কিছুই দেখতে পাচ্ছি নে যেখানে পৌছে বলতে পারি। এইখানেই সমস্ত সমাপ্ত হল, পরিপূর্ণ হল, অতএব এখন থেকে আর কোনোকালেই নড়ব না | সংসারের ধর্মই যখন কেবল ধরে রাখা নয়, সরিয়ে দেওয়া, এগিয়ে দেওয়া- তখন তারই সঙ্গে আমাদের ইচ্ছার সামঞ্জস্য সাধন না করলে দুটােতে কেবলই ঠোকাঠুকি হতে থাকে। আমরা যদি কেবলই বলি, আমরা থািকব আমরা রাখব। আর সংসার বলে, তোমাকে ছাড়তে হবে চলতে হবে তা হলে বিষম কষ্ট উৎপন্ন হতে থাকে । আমাদের ইচ্ছাকে পরাস্ত হতে হয়- যা আমরা ছাড়তে চাই নে তা আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়। অতএব আমাদের ইচ্ছাকেও এই বিশ্বধর্মের সুরে বাঁধতে হবে । , বিশ্বধর্মের সঙ্গে আমাদের ইচ্ছাকে মেলাতে পারলেই আমরা বস্তুত স্বাধীন হই। স্বাধীনতার নিয়মই তাই। আমি স্বেচ্ছায় বিশ্বের সঙ্গে যোগ না দিই। যদি, তা হলেই বিশ্ব আমার প্রতি জবরদস্তি করে আমাকে তার অনুগত করবে— তখন আমার আনন্দ থাকবে না, গীেরব থাকবে না, তখন দাসের মতো সংসারের কানমলা খাব |