পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Q○ァ রবীন্দ্র-রচনাবলী অতি মৃদু, রোগীর দেহে সেখানে দুঃসহ বেদনা। আমাদেরও সেই দশা, বাহিরের সঙ্গে ব্যবহারে মুকুনকৈ থাকছেন। ছােট কথা অত্যন্ত বড়ে কর গুছি ছােটাে বাপর অত্যন্ত ভর হয়ে ভার বাড়ে কখন ; না, কেন্দ্রের দিকে ভারাকর্ষণ যখন বেশি হয়। পৃথিবীতে যে হালকা জিনিস আমরা সহজেই তুলছি, যদি বৃহস্পতিগ্রহে যাই। তবে সেখানে সেটুকু আমাদের হাড় গুড়িয়ে দিতে পারে। কেননা সেখানে এই কেন্দ্রের দিকের আকর্ষণ পৃথিবীর চেয়ে অনেক বেশি। আমরাও তাই দেখছি, আমাদের নিজের কেন্দ্রের দিকের টানটা অত্যন্ত বেশি- আমাদের স্বাৰ্থ ভিতরের দিকেই টানছে, অহংকার ভিতরের দিকেই টানছে, এইজন্যেই সব জিনিসই অত্যন্ত ভারী হয়ে উঠছে— যা তুচ্ছ তা কেবলমাত্র আমার ঐ ভিতরের টানের জোরেই আমাকে কেবলই চাপছে— সব জিনিসই আমাকে ঠেসে ধরেছে— সব কথাই আমাকে ঠেলে দিচ্ছে- ক্ষণকালের শান্তির দ্বারা এটাকে ভুলে থেকে আমাদের লাভটা কী । এই চাপটা হালকা হয়। কখন ? প্ৰেমে । তখন যে ঐ টানটা বাহিরের দিকে যায় । আমাদের জীবনে অনেকবার তার পরিচয় পেয়েছি। যেদিন প্রণয়ীর সঙ্গে আমাদের প্রণয় বিশেষভাবে সার্থক হয়েছে সেদিন কেবল যে আকাশের আলো উজ্জ্বলতর, বনের শ্যামলতা শ্যামলতর হয়েছে তা নয়, সেদিন আমাদের সংসারের ভারাকর্ষণের টান একেবারে আলগা হয়ে গেছে। অন্য দিন ভিক্ষুককে যখন একপয়সামাত্র দিই, সেদিন তাকে আধুলি দিয়ে ফেলি ; অর্থাৎ অন্যদিন এক পয়সার যে ভার ছিল, আজ বত্ৰিশ পয়সার সেই ভার। অন্য দিন যে-কাজে হয়রান হয়ে পড়তুম আজ সে-কাজে ক্লান্তি নেই- হঠাৎ কাজ হালকা হয়ে গেছে। পয়সা সেই পয়সাই আছে, কাজ সেই কাজই আছে, কেবল তার ওজন কমে গেছে কেননা টান যে আজ আমার নিজের কেন্দ্রের দিকে নয় ; প্রেমে যে আমাকে বাইরে টান দিয়ে একেবারে এক মুহুর্তে সমস্ত জগতের বোঝা নামিয়ে দিয়ে গেছে। আমাদের সাধনা যেমনই হােক আমাদের সংসার সেই সঙ্গে যদি হালকা হতে না থাকে। তবে বুঝব। যে হল না। যদি বুঝি টাকার ওজন তেমনি ভয়ানক আছে, উপকরণের বোঝা তেমনিই আমাকে চেপে আছে, তার মধ্যে অতি ছোটােটুকুকেও ফেলে দিতে পারি এমন বল আমার নেই ; যদি দেখি কাজ যত বড়ো তার ভার যেন তার চেয়ে অনেক বেশি, তা হলে বুঝতে হবে প্রেম জোটে নি— আমাদের বরণসভায় বর আসে নি । তবে আর ঐ শান্তিটুকু নিয়ে কী হবে ? ওতে আমাদের আসল জিনিসটা ফাকি দিয়ে অল্পে সন্তুষ্ট করে রাখবে । প্রেমের মধ্যে শুধু শান্তি নেই, তাতে অশান্তিও আছে ; জোয়ারের জলের মতো কেবল যে তার পূর্ণতা, তা নয় ; তারই মতো তার গতিবেগও আছে ; সে আমাদের ভরিয়ে দিয়ে বসিয়ে রাখবে না, সে আমাদের ভাটার মুখের থেকে ফিরিয়ে উলটাে টানে টেনে নিয়ে যাবে— তখন এই আচল সংসারটাকে নিয়ে কেবলই গুণ-টানাটানি লগি-ঠেলা ঠেলি করে মরতে হবে না- সে হুহু করে (NSGP GGK || যতদিন সেই প্রেমের টান না ধরে ততদিন শান্তিতে কােজ নেই- ততদিন অশান্তিকে যেন অনুভব করতে পারি । ততদিন যেন বেদনাকে নিয়ে রাত্রে শুতে যাই এবং বেদনাকে নিয়ে সকাল বেলায় জেগে উঠি- চোখের জলে ভাসিয়ে দাও, স্থির থাকতে দিয়ে না । প্রতিদিন প্রাতে যখন অন্ধকারের দ্বার উদঘাটিত হয়ে যায়, তখন যেন দেখতে পাই, বন্ধু, দাঁড়িয়ে আছ; সুখের দিন হােক, দুঃখের দিন হােক, বিপদের দিন হােক, তোমার সঙ্গে আমার দেখা হল, আজ আমার আর ভাবনা নেই, আমার আজ সমস্তই সহ্য হবে। যখন প্রেম না থাকে, হে সখা, তখনই শান্তির জন্যে দরবার করি। তখন অল্প পুঁজিতে যে কোনো আঘাত সইতে পারি নে। কিন্তু যখন প্রেমের অভ্যুদয় হয় তখন যে-দুঃখ যে-অশান্তিতে সেই প্রেমের পরীক্ষা হবে সেই দুঃখ সেই অশান্তিকেও মাথায় তুলে নিতে পারি। হে বন্ধু, উপাসনার সময় আমি আর শান্তি চাইব না— আমি কেবল প্রেম চাইব । প্রেম শান্তিরূপেও আসবে অশান্তিরূপেও আসবে, সুখ হয়েও আসবে দুঃখ হয়েও