পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন (8S হতে আমাকে তােমার মধ্যে নিয়ে যাও, নইলে যে আমাদের প্রেম কারারুদ্ধ হয়ে থাকে ; হে অমৃত, নিরন্তর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আমাকে তোমার মধ্যে নিয়ে যাও, নইলে যে আমাদের প্ৰেম আসন্নরাত্রির পথিকের মতো নিরাশ্রয় হয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। হে প্রকাশ, তুমি আমার কাছে প্রকাশিত হও, তা হলেই আমার সমস্ত প্রেম সার্থক হবে। আবিরাবীর্ম এধি— হে আবিঃ, হে প্রকাশ, তুমি তো চিরপ্রকাশ, কিন্তু তুমি একবার আমার হও, আমার হয়ে প্রকাশ পাও— আমাতে তােমার প্রকাশ পূর্ণ হােক। হে রুদ্র, হে ভয়ানক- তুমি যে পাপের অন্ধকারে বিরহরীপে দুঃসহ, রুদ্র যত্তে দক্ষিণংমুখং, তোমার যে প্রসন্নসুন্দর মুখ, তোমার যে প্রেমের মুখ, তাই আমাকে দেখাও:- তেন মাং পাহি নিত্যম— তাই দেখিয়ে আমাকে রক্ষা করো, আমাকে বাচাও, আমাকে নিত্যকালের মতো বীচাও— তোমার সেই প্রেমের প্রকাশ, সেই প্ৰসন্নতাই আমার অনন্তকালের পরিত্ৰাণ । হে তপস্বিনী মৈত্ৰেয়ী, এসো, সংসারের উপকরণপীড়িতের হৃদয়ের মধ্যে তোমার পবিত্র চরণ দুটি আজ স্থাপন করো, তোমার সেই অমৃতের প্রার্থনাটি তোমার মৃত্যুহীন মধুর কণ্ঠে আমার হৃদয়ে উচ্চারণ করে যাও— নিত্যকাল যে কেমন করে রক্ষা পেতে হবে, আমার মনে তার যেন লেশমাত্র সন্দেহ না থাকে | ২। পৌষ ১৩১৫ ܔ বিকার-শঙ্কা প্রেমের সাধনায় বিকারের আশঙ্কা আছে । প্রেমের একটা দিক আছে যেটা প্রধানত রসেরই দিকসেইটের প্রলোভনে জড়িয়ে পড়লে কেবলমাত্র সেইখানেই ঠেকে যেতে হয়- তখন কেবল রসসম্ভোগকেই আমরা সাধনার চরম সিদ্ধি বলে জ্ঞান করি । তখন এই নেশায় আমাদের পেয়ে বসে । এই নেশাকেই দিনরাত্রি জাগিয়ে তুলে আমরা কর্মের কঠোরতা জ্ঞানের বিশুদ্ধতাকে ভুলে থাকতে ১াই— কর্মকে বিস্মৃত হই, জ্ঞানকে অমান্য করি । এমনি করে বস্তুত আমরা গাছকে কেটে ফেলে ফুলকে নেবার চেষ্টা করি ; ফুলের সৌন্দর্যে যতই মুগ্ধ হই না, গাছকে যদি তার সঙ্গে তুলনায় নিন্দিত ক'রে, তাকে কঠোর ব’লে, তাকে দূরারোহ বলে উৎপাটন ক’রে ফুলটি তুলে নেবার চেষ্টা করি তা হলে তখনকার মতো ফুলকে পাওয়া যায় কিন্তু চিরদিন সেই ফুল নূতন নূতন করে ফোটবার মূল আশ্রয়কেই নষ্ট করা হয়। এমনি করে ফুলটির প্রতিই একান্ত লক্ষ করে তার প্রতি অবিচার এবং অত্যাচারই করে থাকি । কাব্যের থেকে আমরা ভাবের রস গ্রহণ করে পরিতৃপ্ত হই । কিন্তু সেই রসের সম্পূর্ণতা নির্ভর করে কিসের উপরে ? তার তিনটি আশ্রয় আছে। একটি হচ্ছে কাব্যের কলেবর-— ছন্দ এবং ভাষা ; তা ছাড়া, ভাবকে যেটির পরে যেটিকে যেরূপে সাজালে তার প্রকাশটি সুন্দর হয় সেই বিন্যাসনৈপুণ্য । এই কলেবর-রচনার কাজ যেমন-তেমন করে চলে না— কঠিন নিয়ম রক্ষা করে চলতে হয়- তার একটু ব্যাঘাত হলেই যতিঃপতন ঘটে, কানকে পীড়িত করে, ভাবের প্রকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। অতএব এই ছন্দ, ভাষা এবং ভাববিন্যাসে কবিকে নিয়মের বন্ধন স্বীকার করতেই হয়, এতে যথেচ্ছাচার খাটে নী । তার পরে আর-একটা বড়ো আশ্রয় আছে, সেটা হচ্ছে জ্ঞানের আশ্রয়। সমস্ত শ্রেষ্ঠকাব্যের ভিতরে এমন একটা কিছু থাকে যাতে আমাদের জ্ঞান তৃপ্ত হয়, যাতে আমাদের মননবৃত্তিকেও উদবোধিত করে তোলে। কবি যদি অত্যন্তই খামখেয়ালি এমন একটা বিষয় নিয়ে কাব্য রচনা করেন যাতে আমাদের জ্ঞানের কোনো খাদ্য না থাকে অথবা যাতে সত্যের বিকৃতিবশত মননশক্তিকে পীড়িত করে তোলে। তবে সে-কাব্যে রসের প্রকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়- সে-কাব্য স্থায়িভাবে ও গভীরভাবে আমাদের আনন্দ দিতে পারে না। তার তৃতীয় আশ্রয় এবং শেষ আশ্রয় হচ্ছে ভাবের আশ্রয়— এই