পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

G8 SR রবীন্দ্র-রচনাবলী ভাবের সংস্পর্শে আমাদের হৃদয় আনন্দিত হয়ে ওঠে। অতএব শ্রেষ্ঠকাব্যে প্রথমে আমাদের কানের এবং কলাবােধের তৃপ্তি, তার পরে আমাদের বুদ্ধির তৃপ্তি ও তার পরে হৃদয়ের তৃপ্তি ঘটলে তবেই আমাদের সমগ্র প্রকৃতির তৃপ্তির সঙ্গে সঙ্গে কাব্যের যে-রস তাই আমাদের স্থায়িরাপে প্রগাঢ় রূপে অন্তরকে অধিকার করে। নইলে, হয় রসের ক্ষীণত ক্ষণিকতা, নয়। রসের বিকার ঘটে । চিনি মধু গুড়ের যখন বিকার ঘটে তখন সে গাজিয়ে ওঠে, তখন সে মদে হয়ে ওঠে, তখন সে আপনার পাত্রটিকে ফাটিয়ে ফেলে। মানসিক রসের বিকৃতিতেও আমাদের মধ্যে প্ৰমত্ততা আনে, তখন আর সে বন্ধন মানে না, অধৈর্য-অশান্তিতে সে উচ্ছসিত হয়ে ওঠে । এই রসের উন্মত্ততায় আমাদের চিত্ত যখন উন্মথিত হতে থাকে তখন সেইটোকেই সিদ্ধি বলে জ্ঞান করি । কিন্তু নেশাকে কখনোই সিদ্ধি বলা চলে না, অসতীত্বকে প্রেম বলা চলে না, জ্বরবিকারের দুর্বর উত্তেজনাকে স্বাস্থ্যের বলপ্রকাশ বলা চলে না | মত্ততার মধ্যে যে একটা উগ্ৰ প্ৰবলতা আছে সেটা বস্তুত লাভ নয়- সেটাতে নিজের স্বভাবের অন্য সবদিক থেকেই হরণ করে কেবল একটিমাত্র দিককে অস্বাভাবিকরূপে স্বকীত করে তোলা হয়। তাতে যে কেবল যে-সকল অংশের থেকে হরণ করা হয় তাদেরই ক্ষতি ও কৃশতা ঘটে তা নয়, যে অংশকে ফাপিয়ে মাতিয়ে তোলা হয় তারও ভালো হয় না । কারণ, স্বভাবের ভিন্ন ভিন্ন অংশ যখন সহজভাবে সক্রিয় থাকে তখনই প্রত্যেকটির যোগে প্রত্যেকটি সার্থক হয়ে থাকে- একটির থেকে আর-একটি যদি চুরি করে তবে যার চুরি যায় তারও ক্ষতি হয় এবং চােরও নষ্ট হতে থাকে { তাই বলছিলুম, প্রেম যদি সত্য থেকে জ্ঞান থেকে চুরি করে মত্ত হয়ে বেড়ায়, তার সংযম ও ধৈর্য নষ্ট হয়, তার কল্পনাবৃত্তি উদ্ধৃঙ্খল হয়ে ওঠে, তবে সে নিজের প্রতিষ্ঠাকে নিজের হাতে নষ্ট করে— নিজেকে লক্ষ্মীছাড়া করে তোলে । আমরা যে প্রেমের সাধনা করব সে সতী স্ত্রীর সাধনা | তাতে সতীর তিন লক্ষণই থাকবে- তাতে হী থাকবে, ধী থাকবে এবং শ্ৰী থাকবে । তাতে সংযম থাকবে, সুবিবেচনা থাকবে এবং সৌন্দৰ্য থাকবে ।” এই প্ৰেম সংসারের মধ্যে চলায় ফেরায়, কথায় বার্তায়, কাজে কর্মে দেনায় পাওনায়, ছোটােয় বড়োয়, সুখে দুঃখে, ব্যাপ্তভাবে সুতরাং সংযতভাবে নির্মলভাবে মধুরভাবে প্রকাশ পেতে থাকবে । প্রেমের যে একটি স্বাভাবিক হী আছে সেই লজ্জার আবরণটুকু থাকলেই তবে সে বৃহৎভাবে পরিব্যাপ্ত হতে পারে, নইলে কোনো একটা দিকেই সে জ্বলে উঠে হয়তো কর্মকে নষ্ট করে, জ্ঞানকে বিকৃত করে, সংসারকে আঘাত করে, নিজেকে একদমে খরচ করে ফেলে। হী দ্বারাই সতী স্ত্রী আপনার প্রেমকে ধারণ করে, তাকে নানাদিকে বিকীর্ণ করে দেয়- এইরূপে সে-প্ৰেম কার্ডকে দগ্ধ করে না, সকলকে আলোকিত করে । আমাদের পৃথিবীর এই রকমের একটি আবরণ আছে- সেটি হচ্ছে বাতাসের আবরণ। এই আবরণটির দ্বারাই ধরণী, সূর্যের আলোককে পরিমিত এবং ব্যাপকভাবে সর্বত্র বিকীর্ণ করে দেয় । এই আবরণটি না থাকলে রৌদ্র যেখানটিতে পড়ত। সেখানটিতে দগ্ধ এবং রুদ্ররূপে উজ্জ্বল করত এবং ঠিক তার 5.শেই যেখানে ছায়া সেখানে হিমশীতল মৃত্যু ও নিবিড়তম অন্ধকার বিরাজ করত । অসতীর যে প্রেমে হী নেই, সংযম নেই, সে প্ৰেম নিজেকে পরিমিতভাবে সর্বত্র বিকীর্ণ করতে পারে না, সে প্রেম এক জায়গায় উগ্ৰজ্বালা এবং ঠিক তার পাশেই তেজোহীন আলোকবঞ্চিত ঔদাসীন্য বিস্তার করে । আমাদেরও এই মানস-পুরীর সতীর প্রেমে ধী থাকবে, জ্ঞানের বিশুদ্ধতা থাকবে । এ প্রেম সংস্কারজালে জড়িত মূঢ় প্রেম নয় ; পশুদের মতো একটা সংস্কারগত অন্ধ প্রেম নয়। এর দৃষ্টি জাগ্ৰত, এর চিত্ত উন্মুক্ত। কোনো কল্পনার দ্রব্য দিয়ে এ নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে চায় না- এ যাকে চায় তার অবাধ পরিচয় চায়, তার সম্বন্ধে সে যে নিজের জ্ঞানকে অপমানিত করে রাখবে এ সে সহ করতে পারে না । এর মনে মনে কেবলই এই ভয় যে, পাছে পাবার একান্ত আগ্রহে একটা কোনো ১ স্ত্রীলোকের কোন গুণগুলি শ্রেষ্ঠ তাহার উত্তরে পরম পূজনীয় শ্ৰীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর অগ্রজ মহাশয় কোনো একটি খাতায় লিখিয়াছিলেন- শ্ৰী, হী ও ধী ।