পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(88 রবীন্দ্র-রচনাবলী ফসলের নিশ্চিত আশ্বাসে পরিপূর্ণ। এই জ্যোতির্ময় আশা প্রতিদিনই পুষ্পকুঞ্জকে এবং শস্যক্ষেত্ৰকে দেখা দিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু এই প্রতিদিনের আলোক, এ তো কেবল ফুলের বনে এবং শস্যের খেতে আসছে না ; এ যে রোজই সকলে আমাদের ঘুমের পদাঁ খুলে দিচ্ছে। আমাদেরই কাছে এর কি কোনো কথা নেই। আমাদের কাছেও এই আলো কি প্রত্যহ এমন কোনো আশা আনছে না, যে আশার সফল মূর্তি হয়তে কুঁড়িটুকুর মতো নিতান্ত অন্ধভাবে আমাদের ভিতরে রয়েছে, যার শিষটি এখনো আমাদের জীবনের কেন্দ্ৰস্থল থেকে উর্ধব আকাশের দিকে মাথা তোলে নি ? আলো কেবল একটিমাত্র কথা প্রতিদিন আমাদের বলছে— “দেখো ।” বাস। “একবার চেয়ে দেখো ।” আর কিছুই না । আমরা চোখ মেলি, আমরা দেখি । কিন্তু সেই দেখাটুকু দেখার একটু কুঁড়িমাত্র, এখনো তা অন্ধ । সেই দেখায় দেখার সমস্ত ফসল ধরবার মতো স্বৰ্গভিগামী শিষটি এখনো ধরে নি । বিকশিত দেখা এখনো হয় নি, ভরপুর দেখা এখনো দেখি নি । কিন্তু তবু রোজ সকালবেলায় বহুযোজন দূর থেকে আলো এসে বলছে— দেখো । সেই যে একই মন্ত্র রোজই আমাদের কানে উচ্চারণ করে যাচ্ছে তার মধ্যে একটি অশ্রান্ত আশ্বাস প্রচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে— আমাদের এই দেখার ভিতরে এমন একটি দেখার অন্ধুর রয়েছে যার পূর্ণ পরিণতির উপলব্ধি এখনো আমাদের মধ্যে জাগ্রত হয়ে ওঠে নি । কিন্তু এ কথা মনে কোরো না, আমার এই কথাগুলি অলংকারমাত্র | মনে কোরো না, আমি রূপকে কথা কছি। আমি জ্ঞানের কথা ধ্যানের কথা কিছু বলছি নে, আমি নিতান্তই সরলভাবে চোখে দেখার কথাই বলছি । আলোক যে-দেখাটা দেখায় সে তো ছোটােখাটাে কিছুই নয় । শুধু আমাদের নিজের শয্যাটুকু, শুধু ঘরটুকু তো দেখায় না— দিগন্তবিস্তৃত আকাশমণ্ডলের নীলোজ্বল থালাটির মধ্যে যে সামগ্ৰী সাজিয়ে সে আমাদের সম্মুখে ধরে, সে কী অদ্ভুত জিনিস। তার মধ্যে বিস্ময়ের যে অন্ত পাওয়া যায় না । আমাদের প্রতিদিনের যেটুকু দরকার তার চেয়ে সে যে কতই বেশি। এই যে বৃহৎ ব্যাপারটা আমরা রোজ দেখছি, এই দেখাটা কি নিতান্তই একটা বাহুল্য ব্যাপার। এ কি নিতান্ত অকারণে মুক্তহস্ত ধনীর অপব্যয়ের মতো আমাদের চার দিকে কেবল নষ্ট হবার জন্যেই হয়েছে। এতবড়ো দৃশ্যের মাঝখানে থেকে আমরা কিছু টাকা জমিয়ে, কিছু খ্যাতি নিয়ে কিছু ক্ষমতা ফলিয়েই যেমনি একদিন চােখ বুজাব, অমনি এমন বিরাটজগতে চােখ মেলে চাবার আশ্চর্য সুযোগ একেবারে চূড়ান্ত হয়ে শেষ হয়ে যাবে! এই পৃথিবীতে যে আমরা প্রতিদিন চােখ মেলে চেয়েছিলুম। এবং আলোক এই চোখকে প্রতিদিনই অভিষিক্ত করেছিল, তার কি পুরা হিসােব ঐ টাকা এবং খ্যাতি এবং ভোগের মধ্যে পাওয়া যায় ? ኍ না, তা পাওয়া যায় না । তাই আমি বলছি। এই আলোক অন্ধ কুঁড়িটির কাছে প্রত্যহই যেমন একটি অভাবনীয় বিকাশের কথা বলে যাচ্ছে, আমাদের দেখাকেও সে তেমনি করেই আশা দিয়ে যাচ্ছে যে, একটি চরম দেখা, একটি পরম দেখা আছে সেটি তোমার মধ্যেই আছে। সেইটি একদিন ফুটে উঠবে। বলেই রোজ আমি তোমার কাছে আনাগোনা করছি । তুমি কি ভাবিছ, চােখ বুজে ধ্যানযোগে দেখবার কথা আমি বলছি ? আমি এই চর্মচক্ষে দেখার কথাই বলছি। চর্মচক্ষুকে চর্মচক্ষু বলে গাল দিলে চলবে কেন ? একে শারীরিক বলে তুমি ঘূণা করবে: এতবড়ো লোকটি তুমি কে ? আমি বলছি, এই চােখ দিয়েই, এই চর্মচক্ষু দিয়েই এমন দেখা দেখবার আছে যা চরম দেখা- তাই যদি না থাকত। তবে আলোক বৃথা আমাদের জাগ্রত করছে, তবে এতবড়ো এই গ্ৰহতারা-চন্দ্ৰ-সূৰ্যখচিত প্ৰাণে সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ বিশ্বজগৎ বৃথা আমাদের চারিদিকে অহােরাত্র নানা আকারে আত্মপ্রকাশ করছে। এই জগতের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করার চরম সফলতা কি বিজ্ঞান ? সূর্যের চার দিকে পৃথিবী ঘুরছে— নক্ষত্রগুলি এক-একটি সূর্যমণ্ডল, এই কথাগুলি আমরা জানব বলেই