পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন (8 হচ্ছে। কেবলই উঠছে, কেবলই আসছে সুরের পর সুর, সুরের পর সুর } কাল কৃষ্ণ একাদশীর নিভৃত রাত্রের নিবিড় অন্ধকারকে পূণ করে সেই বীনকার তার রম্য বীণা বাজাচ্ছিলেন ; জগতের প্রান্তে আমি একলা দাঁড়িয়ে শুনছিলুম ; সেই ঝংকারে অনন্ত আকাশের সমস্ত নক্ষত্ৰলোক ঝংকৃত হয়ে অপূর্ব নিঃশব্দ সংগীতে গাথা পড়ছিল। তার পরে যখন শুতে গেলুম তখন এই কথাটি মনে নিয়ে নিদ্রিত হলুম যে, আমি যখন সুপ্তিতে অচেতন থাকব। তখনাে সেই জাগ্রত বীনকারের নিশীথ রাত্রের বীণা বন্ধ হবে না- তখনো তীর যে ঝংকারের তালে নক্ষত্রমণ্ডলীর নৃতা চলছে সেই তালে তালেই আমার নিদ্রানিভূত দেহ-নাট্যশালায় প্রাণের নৃত্য চলতে থাকবে, আমার হৃৎপিণ্ডের নৃত্য থামবে না, সর্বাঙ্গে রক্ত নাচবে এবং লক্ষ লক্ষ জীবকোষ আমার সমস্ত শরীরে সেই জ্যোতিষ্কসভার সংগীতচ্ছন্দেই স্পন্দিত হতে থাকবে । “বাজে বাজে রমবীণা বাজে ।” আবার আমাদের ওস্তাদজি আমাদের হাতেও একটি করে ছোটাে বীণা দিয়েছেন । তার ইচ্ছে আমরাও তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বাজাতে শিখি । তার সভায় তারই সঙ্গে বসে আমরা একটু একটু সংগত করব, এই তার স্নেহের অভিপ্রায় । জীবনের বীণটি ছোটাে কিন্তু এতে কত তারই চড়িয়েছেন । সব তারগুলি সুর মিলিয়ে বাধা কি কম কথা ! এটা হয় তো। ওটা হয় না, মন যদি হল তো আবার শরীর বাদী হয়- একদিন যদি হল তো আবার আর-একদিন তার নেবে যায় । কিন্তু ছাড়লে চলবে না । একদিন তার মুখ থেকে এ কথাটি শুনতে হবে- বাহবা, পুত্র, বেশ । এই জীবনের বীণাটি একদিন, তার পায়ের কাছে গুঞ্জরিয়া গুঞ্জরিয়া তার সব রাগিণীটি বাজিয়ে তুলবে । এখন কেবল এই কথাটি মনে রাখতে হবে যে, সব তারগুলি বেশ এঁটে বাধা চাই– ঢ়িল দিলেই ঝনঝনি খনখন করে । যেমন এটে বাধতে হবে তেমনি তাকে মুক্ত ও রাখতে হবে- তার উপরে কিছু চাপা পড়লে সে আর বাজতে চায় না । নির্মল সুরটুকু যদি চাও তবে দেখো, তারে যেন ধুলো না পড়ে—— মরচে না পড়ে— আর প্রতিদিন তীর পদপ্রান্তে বসে প্রার্থনা কোরো— হে আমার গুরু, তুমি আমাকে বেসুর থেকে সুরে নিয়ে যাও । ৫। পোেষ হিসাব রোজ কেবল লাভের কথাটাই শোনাতে ইচ্ছে হয় । হিসাবের কথাটা পাড়তে মন যায় না । ইচ্ছে করে, কেবল রসের কথাটা নিয়েই নাড়াচাড়া করি, যে-পাত্রের মধ্যে সেই রস থাকে সেটাকে বড়ো কঠিন বলে মনে হয় | } কিন্তু অমৃতের নীচের তলায় সত্য বসে রয়েছেন, তাকে একেবারে বাদ দিয়ে সেই আনন্দলোকে যাবার জো নেই | সত্য হচ্ছেন নিয়মস্বরূপ ৷ তাকে মানতে হলেই তার সমস্ত বাধন মানতেই হয়! যা কিছু সত্য অর্থাৎ যা কিছু আছে এবং থাকে, তা কোনােমতেই বন্ধনহীন হতে পারে না— তা কোনাে নিয়মে আছে বলেই আছে { যে-সত্যের কোনো নিয়ম নেই, বন্ধন নেই, সে তো স্বপ্ন, সে তো খেয়াল- সে তো স্বপ্নের চেয়েও মিথ্যা, খেয়ালের চেয়েও শূন্য । যিনি পূর্ণ সত্যস্বরূপ তিনি অন্যের নিয়মে বদ্ধ হন না, তার নিজের নিয়ম নিজেরই মধ্যে | তা যদি না থাকে, তিনি আপনাকে যদি আপনি বেঁধে না থাকেন, তবে তার থেকে কিছুই হতে পারে না, কিছুই রক্ষা পেতে পারে না। তবে উন্মত্ততার তাণ্ডবনৃত্যে কোনো কিছুর কিছুই ঠিকানা থাকত না । কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, সত্যের রূপই হচ্ছে নিয়ম— একেবারে অব্যৰ্থ নিয়ম- তার কোনো প্রান্তেও লেশমাত্র ব্যত্যয় নেই। এইজন্যেই এই সত্যের বন্ধনে সমস্ত বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড বিধৃত হয়ে আছে,