পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন (ζ (ζ Σ আজকের দিন কি সে কথা আমাদের কাছে কিছু বলছে ? সেই কথাটি না শুনে গেলে কী জন্যেই বা । এসেছি আর কী নিয়েই বা যাব ? সেই যেদিন তঁর জীবনে এই ৭ই পৌষের সূর্য একদিন উদিত হয়েছিল সেই দিনে আলোও জ্বলে নি, জনসমাগমও হয় নি— সেই শীতের নির্মল দিনটি শান্ত ছিল, স্তব্ধ ছিল। সেই দিনে যে কী ঘটছে তা তিনি নিজেও সম্পূর্ণ জানেন নি, কেবল অন্তৰ্য্যামী বিধাতা পুরুষ জািনছিলেন । সেই যে দীক্ষা সেদিন তিনি গ্রহণ করেছিলেন সেটি সহজ ব্যাপার নয়। সে শুধু শান্তির দীক্ষা নয়, সে অগ্নির দীক্ষা। তার প্রভু সেদিন তাকে বলেছিলেন, ‘এই যে জিনিসটি তুমি আজ আমার হাত থেকে নিলে এটি যে সতী— এর ভর যখন গ্রহণ করেছ তখন তোমার আর আরাম নেই, তোমাকে রাত্রিদিন জাগ্রত থাকতে হবে । এই সত্যকে রক্ষা করতে তোমার যদি সমস্তই যায় তো সমস্তই যাক । কিন্তু সাবধান, তোমার হাতে আমার সত্যের অসম্মান না ঘটে ।” তার প্রভুর কাছ থেকে এই সত্যের দান নিয়ে তার পরে আর তো তিনি ঘুমোতে পারেন নি। তার আত্মীয় গেল, ঘর গেল, সমাজ গেল, নিন্দায় দেশ ছেয়ে গেল— এতবড়ো বৃহৎ সংসার, এত মানী বন্ধু, এত ধনী আত্মীয়, এত তার সহায়, সমস্তের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে গেল এমন দীক্ষা তিনি নিয়েছিলেন । জগতের সমস্ত আনুকূল্যকে বিমুখ করে দিয়ে এই সত্যটি নিয়ে তিনি দেশে দেশে অরণ্যে পর্বতে ভ্ৰমণ করে বেড়িয়েছেন। এ যে প্রভুর সত্য। এই অগ্নি রক্ষার ভার নিয়ে আর আরাম নেই, আর নিদ্রা নেই। রুদ্রদেবের সেই অগ্নিদীক্ষা আজকের দিনের উৎসবের মাঝখানে আছে। কিন্তু সে কি প্রচ্ছন্নই থাকবে ? এই গীতবাদাকোলাহলের মাঝখানে প্রবেশ করে সেই ‘ভয়ানাং ভয়ং ভীষণং ভীষপনাং' যিনি তার দীপ্ত সত্যের বজমুর্তি আজ প্রত্যক্ষ করে যাবে না ? গুরুর হাত হতে সেই যে “বজমুদ্যতং” তিনি গ্রহণ করেছিলেন, এই ৭ই পৌষের মর্মস্থানে সেই বজতেজ রয়েছে। কিন্তু শুধু বাজ নয়, শুধু পরীক্ষা নয়, সেই দীক্ষার মধ্যে যে কী বরাভয আছে তাও দেখে যেতে হবে । সেই ধ্বনিসন্তানের জীবনে যে সংকটের দিন এসেছিল তা তো সকলের জানা আছে। যে বিপুল ঐশ্বর্য রাজহর্মের মতো একদিন তার আশ্রয় ছিল সেইটে যখন অকস্মাৎ তার মাথার উপরে ভেঙে প'ড়ে তাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবার উদযোগ করেছিল তখন সেই ভয়ংকর বিপৎপতনের মাঝখানে একমাত্র এই সত্যদীিক্ষা তাকে আবৃত করে রক্ষা করেছিল— সেইদিন তার আর-কোনো পার্থিব সহায় ছিল না । এই দীক্ষা শুধু যে দুর্দিনের দারুণ আঘাত থেকে তাকে বঁচিয়েছিল, তা নয়— প্রলোভনের দারুণতর আক্রমণ থেকে তাকে রক্ষা করেছিল । আজকের এই ৭ই পৌষের মাঝখানে তার সেই সত্যাদীক্ষার রুদ্ৰদীপ্তি এবং বরাভয়ারূপ দুইই রয়েছে- সেটি যদি আমরা দেখতে পাই এবং লেশমাত্ৰও গ্রহণ করতে পারি। তবে ধন্য হব । সত্যের দীক্ষা যে কাকে বলে, আজ যদি ভক্তির সঙ্গে তাই স্মরণ করে যেতে পারি তা হলে ধন হব । এর মধ্যে ফাকি নেই, লুকোচুরি নেই, দ্বিধা নেই, দুই দিক বজায় রেখে চলাবার চাতুরী নেই, নিজেকে ভোলাবার জন্যে সুনিপুণ মিথ্যাযুক্তি নেই, সমাজকে প্ৰসন্ন করবার জন্যে বুদ্ধির দুই চক্ষু অন্ধ করা নেই, মানুষের হাটে বিকিয়ে দেবার জন্যে ভগবানের ধন চুরি করা নেই । সেই সত্যকে সমস্ত দুঃখপীড়নের মধ্যে স্বীকার করে নিলে তার পরে একেবারে নির্ভয়, ধূলিঘর ভেঙে দিয়ে একেবারে পিতৃভবনের অধিকার . লাভ— চিরজীবনের যে গম্যস্থান, যে অমৃতনিকেতন, সেই পথের যিনি একমাত্র বন্ধু তাঁরই আশ্ৰয়প্রাপ্তি, সত্যািদীক্ষার এই অর্থ | সেই সাধু সাধক তীর জীবনের সকলের চেয়ে বড়ো দিনটিকে, তার দীক্ষার দিনটিকে, এই নির্জন প্রান্তরের মুক্ত আকাশ ও নির্মল আলোকের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করে রেখে দিয়ে গেছেন। তার সেই মহাদিনটির চারি দিকে এই মন্দির, এই আশ্রম, এই বিদ্যালয় প্রতিদিন আকার ধারণ করে উঠছে ; আমাদের জীবন, আমাদের হৃদয়, আমাদের চেতনা একে বেষ্টন করে দাড়িয়েছে ; এই দিনটিরই আহবানে কল্যাণ মূর্তিমান হয়ে এখানে আবির্ভূত হয়েছে ; এবং তার সেই সতদীক্ষার দিনটি ধনী ও দরিদ্রকে, বালক ও বৃদ্ধকে, জ্ঞানী ও মুখকে বর্ষে বর্ষে আনন্দ-উৎসবে আমন্ত্রণ করে আনছে। এই