পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন (፩ (፩ (? বিশ্বমানবও এমনি করেই এক যুগ থেকে আর-এক যুগে যাবার আয়ােজন করছে। যখন নূতন প্রভাত উঠছে, যখন রাত ভোর হবে-হবে করছে— তখন এ ওকে ঠেলাঠেলি করে ডাকছে— ওরে চল রে- ওরে গোরু কোথায় রে, ওরে গাড়ি কোথায় । তখন ঐ রাত্রির অত্যন্ত প্রয়োজনের সামগ্ৰীগুলো এই দিনের আলোতে অত্যন্ত আবর্জনা হয়ে লজ্জিত হয়ে পড়ে রইল। শুকনাে পাতা থেকে এখনাে ধোয়া উঠছে, তার ছাইগুলো জমে উঠছে। ভাঙা হাঁড়িসরা, শালপাতায় মাঠ বিকীর্ণ। আশ্রয়গৃহগুলি আশ্রিতদের দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে অত্যন্ত শ্ৰীভ্রষ্ট ও লজ্জিত হয়ে আছে। সমস্তই রইল— পূর্বকাশ রাঙা হয়ে উঠেছে— এবারে যাত্রা করে বেরোতে হবে। আবার, আবার আর-এক যুগের প্রয়োজন সংগ্ৰহ করতে হবে । তখন মনে হবে, এইবারকার এই প্রয়োজনগুলিই চৱম- আর কোনো দিন ভোরের বেলায় গাড়িতে গোরু জুততে হবে না। এই বলে আবার কাঠাকুটাে ডালপালা সংগ্রহে প্রবৃত্ত হওয়া যায়। কিন্তু তখনাে এই অত্যন্ত একান্ত প্রয়ােজনের দূর সম্মুখ দিগন্ত থেকে করুণ ভৈরবীসুরে বাণী আসছে, প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই। যদি এই সুরটুকু না থাকত— যদি এই অত্যন্ত প্রয়োজনের ভিতরেই অত্যন্ত অপ্রয়োজন বাস না করত তা হলে কি আমরা বাঁচতে পারতুম। প্রয়ােজন যদি সত্যই একান্ত হত তা হলে তাঁর ভয়ংকর চাপ কে সহ্য করতে পারত । অত্যন্ত অপ্রয়োজনের দিন ও রাত্রি এই অত্যন্ত প্রয়োজনের ভার হরণ করে রয়েছে বলেই আমরা দরকারের অতি প্রবল মাধ্যাকর্ষণের মধ্যেও চলাফেরা করে বেড়াতে পারছি। সেইজন্যেই ভোরের আলো দেখা দেবা মাত্রই রাশীকৃত বোঝা যেখানে-সেখানে যেমন-তেমন করে ফেলে রেখে আমরা গাড়িতে চড়ে বসতে পারছি। “কিছুই থাকে না” বলে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলছি— তেমনি “কিছুই নড়ে না” বলে হতাশ হয়ে পড়ছি নে ! থাকছেও বটে, যাচ্ছেও বটে, এই দুইয়ের মাঝখানে আমরা ফােকও পেয়েছি, আশ্রয়ও পেয়েছি— আমাদের ঘরও জুটেছে, আলো-বাতাসও মারা राशि न् ि। ৮ পোষ উৎসবশেষ আমরা অনেক সময় উৎসব করে ফতুর হয়ে যাই । ঋণশোধ করতেই দিন বয়ে যায় । অল্পসম্বল ব্যক্তি যদি একদিনের জন্যে রাজা হওয়ার শখ মেটাতে যায়। তবে তার দশদিনকে সে দেউলে করে দেয়, আর তো কোনো উপায় নেই । সেইজন্যে উৎসবের পরদিন আমাদের কাছে বড়ো স্নান । সেদিন আকাশের আলোর উজ্জ্বলতা চলে যায়— সেদিন অবসাদে হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে । কিন্তু উপায় নেই। মানুষ বৎসরে অন্তত একটা দিন নিজের কার্পণ্য দূর করে তবে সেই অকৃপণের সঙ্গে আদানপ্রদানের সম্বন্ধ স্থাপন করতে চায়। ঐশ্বর্যের দ্বারা সেই ঈশ্বরকে উপলব্ধি করে । দুই রকমের উপলব্ধি আছে। একরকম— দরিদ্র যেমন ধনীকে উপলব্ধি করে, দানপ্ৰাপ্তির দ্বারা । এই উপলব্ধিতে পার্থক্যটাকেই বেশি করে বোঝা যায়। আর একরকম উপলব্ধি হচ্ছে সমকক্ষতার উপলব্ধি । সেইস্থলে আমাকে দ্বারের বাইরে বসে থাকতে হয় না- কতকটা এক জাজিমে বসা চলে। প্রতিদিন যখন আমরা দীনভাবে থাকি তখন নিরানন্দ চিত্তটা আনন্দময়ের কাছে ভিক্ষকতা করে । উৎসবের দিনে সেও বলতে চায়, আজ কেবল নেওয়া নয়, আজ আমিও তোমার মতো আনন্দ করব— আজ আমার দীনতা নেই, কৃপণতা নেই, আজ আমার আনন্দ এবং আমার ত্যাগ তোমারই মতো অজস্র । এইরূপে ঐশ্বৰ্য জিনিসটি কী, অকৃপণ প্রাচুর্য কাকে বলে, সেটা নিজের মধ্যে অনুভব করলে ঈশ্বর ՀINՉՎչ