পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন 登“S সফল হয় তারা আপনাকে ত্যাগ করে সফল হয় | এইজন্য দীন যে, সে সেখানে ধন্য । যে অহংকার করবার কিছুই রাখে নি, সেই ধন্য— কেননা, ঈশ্বর স্বয়ং যেখানে নত হয়ে আমার কাছে এসেছেন, সেখানে যে নত হতে পারবে সেই তাকে পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে পারবে । এইজন্যেই প্রতিদিন প্রার্থনা করি ; নমস্তেহস্তু— তোমাকে যেন নমস্কার করতে পারি, যেন নত হতে পারি, নিজের অভিমান কোথাও কিছু যেন না থাকে । জগতে তুমি রাজা অসীমপ্রতাপ, হৃদয়ে তুমি হৃদয়নাথ হৃদয়হরণ রূপ । নীলাম্বর জ্যোতিখচিত চরণপ্রান্তে প্রসারিত, ফিরে সভয়ে নিয়মপথে অনন্তলোক । নিভৃত হৃদয়-মাঝে কিবা প্ৰসন্ন মুখচ্ছবি, প্ৰেমপরিপূর্ণ মধুরভাতি । দীনজনে সতত কর অভয়দান । ২৫ পৌষ সমগ্ৰ এই প্ৰাতঃকালে যিনি আমাদের জাগালেন তিনি আমাদের সব দিক দিয়েই জাগালেন । এই যে আলোটি ফুটে পড়েছে। এ আমাদের কর্মের ক্ষেত্রেও আলো দিচ্ছে, জ্ঞানের ক্ষেত্রেও আলো দিচ্ছে— সৌন্দর্যক্ষেত্ৰকেও আলোকিত করছে । এই ভিন্ন ভিন্ন পথের জন্যে তিনি ভিন্ন ভিন্ন দূত পাঠান নি— তীর একই দৃত সকল পথেরই দৃত হয়ে হাস্যমুখে আমাদের সম্মুখে অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু আমাদের বোঝবার প্রক্রিয়াই এই যে, সত্যকে আমরা এক মুহূর্তে সমগ্র করে দেখতে পাই নে। প্রথমে খণ্ড খণ্ড করে, তার পরে জোড়া দিয়ে দেখি । এই উপায়ে খণ্ডের হিসাবে সত্য করে দেখতে গিয়ে সমগ্রের হিসাবে ভুল করে দেখি । ছবিতে একটি পরিপ্রেক্ষণতত্ত্ব আছে- তদনুসারে দুরকে ছোটাে করে এবং নিকটকে বড়ো করে আঁকতে হয় । তা যদি না করি তবে ছবিটি আমাদের . কাছে সত্য বলে মনে হয় না । কিন্তু সমগ্ৰ সত্যের কাছে দূর নিকট নেই, সবই সমান নিকট | এইজন্যে নিকটকে বড়ো করে ও দূরকে ছোটাে করে দেখা সারা হলে তার পরে সমগ্ৰ সত্যের মধ্যে তাকে সংশোধন করে নিতে হয় । মানুষ একসঙ্গে সমস্তকে দেখবার চেষ্টা করলে সমস্তকেই ঝাপসা দেখে বলেই প্রথমে খণ্ড খণ্ড করে তার পরে সমস্তর মধ্যে সেটা মিলিয়ে নেয়। এইজন্য কেবল খণ্ডকে দেখে সমগ্রকে যদি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে, তবে তার ভয়ংকর জবাবদিহি আছে ; আবার কেবল সমগ্রকে লক্ষ্য করে খণ্ডকে যদি বিলুপ্ত করে দেখে তবে সেই শূন্যতা তার পক্ষে একেবারে ব্যর্থ হয় । এ কয়দিন আমরা প্রাকৃতিক ক্ষেত্র এবং আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রকে স্বতন্ত্র করে দেখছিলুম। এরকম না করলে তাদের সুস্পষ্ট চিত্র আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ হতে পারে না । কিন্তু প্রত্যেকটিকে যখন সুস্পষ্টভাবে জানা সারা হয়ে যায় তখন একটা মস্ত ভুল সংশোধনের সময় আসে। তখন পুনর্বাের এই দুটিকে একের মধ্যে যদি না দেখি তা হলে বিপদ ঘটে । এই প্রাকৃতিক ও আধ্যাত্মিক যেখানে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য লাভ করেছে সেখান থেকে আমাদের লক্ষ যেন একান্ত স্থলিত না হয় । যেখানে সত্যের মধ্যে উভয়ের আত্মীয়তা আছে সেখানে মিথ্যার দ্বারা আত্মবিচ্ছেদ না ঘটাই। কেবলমাত্র ভাষা, কেবল তর্ক, কেবল মোহের দ্বারা প্রাচীর গেঁথে তুলে সেইটেকেই সত্য পদাৰ্থ বলে যেন ভুল না করি ।