পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ ケ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রাণের মধ্যে আনন্দ এবং কর্ম এই দুটাে জিনিস একত্র মিলিত হয়ে রয়েছে। প্রাণের সচেষ্টতাতেই প্ৰাণের আনন্দ- প্ৰাণের আনন্দেই তাঁর সচেষ্টতা । অতএব, ব্ৰহ্মই যদি সমস্ত সৃষ্টির প্রাণস্বরূপ হন, তিনিই যদি সৃষ্টির মধ্যে গতির দ্বারা আনন্দ ও আনন্দের দ্বারা গতি সঞ্চার করছেন, তবে যিনি ব্ৰহ্মবাদী তিনি শুধু ব্ৰহ্মকে নিয়ে আনন্দ করবেন না। তো, তিনি ব্ৰহ্মকে নিয়ে কর্মও করবেন । তিনি যে ব্ৰহ্মবাদী । তিনি তো শুধু ব্ৰহ্মকে জানেন তা নয়, তিনি যে ব্ৰহ্মকে বলেন । না বললে তার আনন্দ বধ মানবে কেন ? তিনি বিশ্বের প্রাণস্বরূপ ব্ৰহ্মকে প্ৰাণের মধ্যে নিয়ে "ভাবতে নাতিবাদী অর্থাৎ, ব্ৰহ্মকে বাদ দিয়ে কোনো কথা বলতে চান না— তিনি ব্ৰহ্মকেই বলতে চান । মানুষ ব্ৰহ্মকে কেমন করে বলে y সেতারের তার যেমন করে গানকে বলে । সে নিজের সমস্ত গতির দ্বারা, স্পন্দনের দ্বারা, ক্রিয়ার দ্বারাই বলে- সর্বতোভাবে গানকে প্রকাশের দ্বারাই সে. নিজের সার্থকতা সাধন করে । ব্ৰহ্ম নিজেকে কেমন করে বলছেন ? নিজের ক্রিয়ার দ্বারা অনন্ত আকাশকে আলোকে ও আকারে পরিপূর্ণ করে, স্পন্দিত করে, ঝংকৃত করে তিনি বলছেন— আনন্দরূপমমূতং যদবিভতি— তিনি কর্মের মধ্যেই আপনি আনন্দবাণী বলছেন, আপনি অমৃতসংগীত বলছেন । তার সেই আনন্দ এবং তার কর্ম একেবারে একাকার হয়ে দুলোকে ভূলোকে বিকীর্ণ হয়ে পড়েছে । ব্ৰহ্মবাদীও যখন ব্ৰহ্মকে বলবেন তখন আর কেমন করে বলবেন ? তাকে কর্মের দ্বারাই বলতে হবে । তাকে ক্রিয়াবান হতে হবে । সে কম কেমন কর্ম % না, যে কৰ্মদ্বারা প্রকাশ পায় তিনি ‘আত্মত্রীড় আত্মরতিঃ, পরমাত্মায় তার ক্রীড়া, পরমাত্মায় তার আনন্দ । যে কমে প্রকাশ পায় তার আনন্দ নিজের স্বাথসাধনে নয়, নিজের গৌরববিস্তারে নয় । তিনি যে, নাতিবাদী" — তিনি পরমাত্মাকে ছাড়া নিজের কর্মে আর কাউকেই প্ৰকাশ করতে চান না । তাই সেই ‘ব্রহ্মবিদাং বরিষ্ঠঃ তার জীবনের প্রত্যেক কাজে নানা ভাষায় নানা রূপে এই সংগীত ধ্বনিত করে তুলছেন– শান্তম শিবমদ্বৈতম | জগৎক্রিয়ার সঙ্গে তাঁর জীবন ক্রিয়া এক ছন্দে এক রাগিণীতে গান করছে । অন্তরের মধ্যে যা আত্মত্রীড়া, যা পরমাত্মার সঙ্গে ক্রীড়া, বাহিরে সেইটিই যে জীবনের কর্ম | অন্তরের সেই আনন্দ বাহিরের সেই কর্মে উচ্ছসিত হচ্ছে, বাহিরেব সেই কর্ম অন্তরের সেই আনন্দে আবার ফিরে ফিরে যাচ্ছে । এমনি করে অন্তরে বাহিরে আনন্দ ও কর্মের অপূর্ব সুন্দর আবর্তন চলছে এবং সেই আবর্তনবেগে নব নব মঙ্গললোকের সৃষ্টি হচ্ছে । সেই আবর্তনবেগে জ্যোতি উদ্দীপ্ত হচ্ছে, প্রেম উৎসারিত হয়ে উঠছে | এমনি করে যিনি চরাচর নিখিলে প্রাণরূপে অর্থাৎ একই কালে আনন্দ ও কর্ম -রূপে প্ৰকাশমান, সেই প্ৰাণকে ব্ৰহ্মবিৎ আপনার প্রাণের দ্বারাই প্রকাশ করেন । সেইজনো আমার প্রার্থনা এই যে, হে প্ৰাণস্বরূপ, আমার সেতাবের তারে যেন মরচে না পড়ে, যেন ধুলো না জমে।— বিশ্বপ্রাণের স্পন্দনাভিঘাতে সে দিনরাত বাজতে থাকুক- কর্মসংগীতে বাজতে থাকুক।— তোমারই নামে বাজতে থাকুক ! প্রবল আঘাতে মাঝে মাঝে যদি তার ছিড়ে যায় তো সেও ভালো, কিন্তু শিথিল না হয়, মলিন না হয়, ব্যর্থ না হয় । ক্রমেই তার সুর প্রবল হােক, গভীর হােক, সমস্ত অস্পষ্টত পরিহার করে সত্য হয়ে উঠুক— প্রকৃতির মধ্যে ব্যাপ্ত এবং মানবাত্মার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হােক— হে আবিঃ, তোমার আবির্ভাবের দ্বারা সে ধন্য হােক । ২৯ পৌষ