পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৫৯২ – রবীন্দ্র-রচনাবলী বাহুল্য বলা হয়, তার পরে আবার কথাটাকে অত্যন্ত নামিয়ে নিয়ে আসা হয় । এই সকল কারণে আমাদের উপাসনার এই মন্ত্রটি দীর্ঘকাল আমাকে পীড়িত করেছে। অন্তঃকরণ যখন ভাবকে গ্রহণ করবার জন্যে প্রস্তুত থাকে না তখন শ্রদ্ধাহীন শ্রোতার কাছে কথাগুলি তার সমস্ত অর্থটা উদঘাটিত করে দেয় না । অধ্যাত্মমন্ত্রকে যখন সাহিত্য-সমালোচকের কান দিয়ে শুনেছি তখন সাহিত্যের দিক দিয়েও তার ঠিক বিচার করতে পারি নি । আমি সেজন্যে অনুতপ্ত নই, বরঞ্চ আনন্দিত । মূল্যবান জিনিসকে তখনই লাভ করা সৌভাগ্য, যখন তার মূল্য বােঝবার শক্তি কিছু পরিমাণে হয়েছে— যথার্থ অভাবের পূর্বে পেলে পাওয়ার আনন্দ ও সফলতা থেকে বঞ্চিত হতে হয় । পূর্বে আমি দেখতে পাই নি যে, এই মন্ত্রের দুটি ছত্রে দুটি ক্রিয়াপদ প্রধান স্থান অধিকার করে আছে । একটি হচ্ছে পর্যগাৎ- তিনি সর্বত্রই গিয়েছেন, সর্বত্রই আছেন । আর-একটি হচ্ছে ব্যদধাৎতিনি সমস্তই করেছেন । এই মস্ত্রের এক অর্ধে তিনি আছেন, অন্য অর্ধে তিনি করছেন । যেখানে আছেন সেখানে ক্লীবলিঙ্গ বিশেষণ-পদ, যেখানে করছেন সেখানে পুংলিঙ্গ বিশেষণ । অতএব বাহুল্য কোনো কথা না বলে একটি ব্যাকরণের ইঙ্গিতের দ্বারা এই মন্ত্র একটি গভীর সার্থকতা লাভ করেছে । তিনি সর্বত্র আছেন, কেননা তিনি মুক্ত, তার কোথাও কোনো বাধা নেই। না আছে শরীরের বাধা, না আছে পাপের বাধা । তিনি আছেন এই ধ্যানটিকে সম্পূর্ণ করতে গেলে তার সেই মুক্ত বিশুদ্ধ স্বরূপকে মনে উজ্জ্বল করে দেখতে হয় । তিনি যে কিছুতেই বদ্ধ নন। এইটিই সর্বব্যাপিত্বের লক্ষণ । শরীর যার আছে সে সর্বত্র নেই। শুধু সর্বত্র নেই তা নয় সে সর্বত্র নির্বিকারভাবে থাকতে পারে না, কারণ শরীরের ধর্মই বিকার । তার শরীর নেই, সুতরাং তিনি নির্বিকার, তিনি অব্ৰণ । যার শরীর আছে সে ব্যক্তি স্নায়ু প্রভৃতির সাহায্যে নিজের প্রয়োজনসাধন করে- সেরকম সাহায্য তার পক্ষে সম্পূর্ণ অনাবশ্যক । শরীর নেই বলার দরুন কী বলা হল তা ঐ অব্ৰণ ও অস্নাবিক বিশেষণের দ্বারা ব্যক্তি করা হয়েছে- তীব্র শারীরিক সীমা নেই, সুতরাং তার বিকার নেই এবং খণ্ডভাবে খণ্ড উপকরণের দ্বারা তঁাকে কাজ করতে হয় না । তিনি শুদ্ধং অপাপবিদ্ধং- কোনো প্রকার পাপ প্রবৃত্তি তাকে এক দিকে হেলিয়ে এক দিকে বেঁধে রাখে না । সুতরাং তিনি সবত্রই সম্পূর্ণ সমান । এই তো গোল—স পর্যগাং । তার পরে- স ব্যদধাৎ । যেমন অনন্ত দেশে তিনি পর্যগাৎ, তেমনি অনন্তকালে তিনি বাদধাৎ । ব্যদধাৎ শাশ্বতী ভ্যঃ সমাভ্যঃ । নিত্যকাল হতে বিধান করেছেন এবং নিত্যকালের জন্য বিধান করছেন । সে বিধান কিছুমাত্র এলোমেলো নয়- যাথা তথ্যতোহ্যর্থন ব্যদধাৎ- যেখানকার যেটি অর্থ ঠিক সেইটেই একেবারে যথাতথিরূপে বিধান করছেন । তার আর লেশমাত্র বাত্যয় হবার জো নেই । এই যিনি বিধান করেন তার স্বরূপ কী ? তিনি কবি ; এ স্থলে কবি শব্দের প্রতিশব্দস্বরূপ সর্বদশী কথাটা ঠিক চলে না । কেননা, এখানে তিনি যে কেবল দেখছেন তা নয়, তিনি করছেন । কবি শুধু দেখেন জানেন তা নয়, তিনি প্রকাশ করেন । তিনি যে কবি, অর্থাৎ তঁর আনন্দ যে একটি সুশৃঙ্খল সুষমার মধ্যে সুবিহিত ছন্দে নিজেকে প্রকাশ করছে, তা তার এই জগৎ-মহাকাব্য দেখলেই টের পাওয়া যায়! জগৎপ্রকৃতিতে তিনি কবি, মানুষের মনঃপ্রকৃতিতে তিনি অধীশ্বব । বিশ্বমানবের মন-যে আপনা আপনি যেমন-তেমন করে একটা কাণ্ড করছে তা নয়, তিনি তাকে নিগৃঢ়ভাবে নিয়ন্ত্রিত করে ক্ষুদ্র থেকে ভূমার দিকে, স্বাৰ্থ থেকে পরমার্থের দিকে নিয়ে চলেছেন । তিনিই হচ্ছেন পরিভৃঃ । কী জগৎপ্রকৃতি কী মানুষের মন সর্বত্র তীর প্রভুত্ব । কিন্তু তার কবিত্ব ও প্রভুত্ব বাইরের কিছু থেকে নিয়মিত হচ্ছে না, তিনি স্বয়ত্ত্ব- তিনি নিজেকেই নিজে প্রকাশ করেন । এইজন্যে তার কর্মকে, তার বিধানকে বাইরে থেকে দেশে বা কালে বাধা দেবার কিছুই নেই- এবং এই কারণেই শাশ্বতকালে তার বিধান এবং যথাতথরূপে তার বিধান । আমাদের স্বভাবেও এইরকম ভাববাচ্য ও কর্মবাচ্য দুই বাচ্য আছে। আমরাও হই এবং করি । আমাদের হওয়া যতই বাধামুক্ত ও সম্পূর্ণ হবে আমাদের করাও ততই সুন্দর ও যথাযথ হয়ে উঠবে।