পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

O S রবীন্দ্র-রচনাবলী সহজেই গলা জড়িয়ে ধরে মানুষকে ভাই বলতে পারে- যাদের দয়া সহজেই প্রকাশ পায়, অশ্রু সহজেই নিঃসারিত হয় এবং সেইরূপ ভাব-অনুভব ও ভাব-প্রকাশকেই তারা ফললাভ বলে গণ্য করে। সুতরাং ঐখানেই থেমে পড়ে, আর বেশিদূর যায় না । এই ভাবের রসকে আমি নিরর্থক বলি নে । কিন্তু একেই যদি লক্ষ্য বলে ভুল করি তা হলে এই জিনিসটি যে কেবল নিরর্থক হয় তা নয়, এ অনিষ্টকর হয়ে ওঠে । এইভাবকেই লক্ষ্য বলে ভুল মানুষ সহজেই করে, কারণ এর মধ্যে একটা নেশা আছে । ঈশ্বরের আরাধনা-উপাসনার মধ্যে দুটি পাবার পন্থা আছে। গাছ দুরকম করে খাদ্য সংগ্রহ করে । এক তার পল্লবগুলি দিয়ে বাতাস ও আলোক থেকে নিজের পুষ্টি গ্রহণ করে— আর এক তার শিকড় থেকে সে নিজের খাদ্য আকর্ষণ করে নেয় । কখনো বৃষ্টি হচ্ছে, কখনাে রৌদ্র উঠছে, কখনাে শীতের বাতাস দিচ্ছে, কখনো বসন্তের হাওয়া বইছে— ‘পল্লবগুলি চঞ্চল হয়ে উঠে তারই থেকে আপনার যা নেবার তা নিচ্ছে। তার পরে আবার শুকিয়ে ঝরে পড়ছে— আবার নতুন পাতা উঠছে | 曝 কিন্তু শিকড়ের চাঞ্চল নেই । সে নিয়ত স্তব্ধ হয়ে, দৃঢ় হয়ে, গভীরতার মধ্যে নিজেকে বিকীর্ণ করে দিয়ে নিয়ত আপনার খাদ্য নিজের একান্ত চেষ্টায় গ্রহণ করছে। আমাদেরও শিকড় এবং পল্লব এই দুটাে দিক আছে। আমাদের আধ্যাত্মিক খাদ্য এই দুই দিক থেকেই নিতে হবে | শিকড়ের দিক থেকে নেওয়া হচ্ছে প্রধান ব্যাপার | এইটিই হচ্ছে চরিত্রের দিক, এটা ভাবের দিক নয় । উপাসনার মধ্যে এই চরিত্র দিয়ে যা আমরা গ্ৰহণ করি তাই আমাদের প্রধান খাদ্য । সেখানে চাঞ্চল্য নেই, সেখানে বৈচিত্র্যের অন্বেষণ নেই- সেইখানেই আমরা শান্ত হই, স্তব্ধ হই, ঈশ্বরের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হই । সেই জায়গাটির কাজ বড়ো অলক্ষ্য, বড়ো গভীর। সে ভিতরে ভিতরে শক্তি ও প্ৰাণ সঞ্চয় করে কিন্তু ভাবব্যক্তির দ্বারা নিজেকে প্রকাশ করে না । সে ধারণ করে, পোষণ করে এবং গোপনে থাকে { এই চরিত্র যে-শক্তির দ্বারা প্ৰাণ বিস্তার করে তাকে বলে নিষ্ঠ । সে অশ্রুপূর্ণ ভাবের আবেগ নয়, সে নিষ্ঠ । সে নড়তে চায় না, সে যেখানে ধরে আছে সেখানে ধরেই আছে, কেবলই গভীর থেকে গভীরতরে গিয়ে নাবিছে। সে শুদ্ধচারিণী স্নাত পবিত্র সেবিকার মতো সকলের নীচে জোড়হাতে ভগবানের পায়ের কাছে দাড়িয়ে আছে- দাডিয়েই আছে | হৃদয়ের কত পরিবর্তন । আজ তার যে-কথায় তৃপ্তি, কাল তার তাতে বিতৃষ্ণা । তার মধ্যে জোয়ার ভাটা খেলছে, কখনো তার উল্লাস কখনো অবসাদ । গাছের পল্লবের মতো তার বিকাশ আজ নূতন হয়ে উঠছে, কাল জীর্ণ হয়ে পড়ছে। এই পল্লবিত চঞ্চল হৃদয় নব নব ভাব-সংস্পর্শের জন্য ব্যাকুলতায় স্পন্দিত । কিন্তু মূলের সঙ্গে, চরিত্রের সঙ্গে, যদি তার অবিচলিত অবিচ্ছিন্ন যোগ না থাকে তা হলে এই-সকল ভাবসংস্পর্শ তার পক্ষে আঘাত ও বিনাশেরই কারণ হয় । যে গাছের শিকড় কেটে দেওয়া হয়েছে, সূর্যের আলো তাকে শুকিয়ে ফেলে, বৃষ্টির জল তাকে পচিয়ে দেয়। আমাদের চরিত্রের ভিতরকার নিষ্ঠ যদি যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্য জোগানো বন্ধ করে দেয় তা হলে ভাবের ভোগ আমাদের পুষ্টিসাধন করে না, কেবল বিকৃতি জন্মাতে থাকে। দুর্বল ক্ষীণ চিত্তের পক্ষে ভাবের খাদ্য কুপথ্য হয়ে ওঠে। ] চরিত্রের মূল থেকে প্রত্যহ আমরা পবিত্ৰতা লাভ করলে তবেই ভাবুকতা আমাদের সহায় হয় । ভােবরসকে খুঁজে বেড়াবার দরকার নেই, সংসারে ভাবের বিচিত্র প্রবাহ নানা দিক থেকে আপনিই এসে পড়ছে। পবিত্রতাই সাধনার সামগ্ৰী । সেটা বাইরের থেকে বর্ষিত হয় না— সেটা নিজের থেকে আকর্ষণ করে নিতে হয়। এই পবিত্ৰতাই আমাদের মূলের জিনিস, আর ভাবুকতা পল্লবের । প্রত্যহ আমাদের উপাসনায় আমরা সুগভীর নিস্তব্ধ-ভাবে সেই পবিত্রত গ্রহণের দিকেই আমাদের