পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন とのq কিন্তু আমরা সেই ভেদটুকুকে রক্ষা করি নে ! আমরা বাইরের সমস্ত জমাখরচ ভিতরের খাতাতে পাকা করে লিখে অমন সোনার জলে বাধানো দামি বইটাকে নষ্ট করি । বাইরের বিকারকে ভিতরে পাপকল্পনারূপে চিহ্নিত করি, বাইরের আঘাতকে ভিতরে বেদনায় জমা করে রাখতে থাকি । আমাদের ভিতরের মহালে একটা স্থায়িত্বের ধর্ম আছে-- সেখানে জমা করবার জায়গা। এইজনে সেখানে এমন-কিছু নিয়ে গিয়ে ফেলা ঠিক নয় যা জমাবার জিনিস নয়। তা নিয়ে গেলেই বিকারকে স্থায়ী করে তোলা হয় । মৃতদেহকে কেউ অন্তঃপুরের ভাণ্ডারে তুলে রাখে না, তাকে বাইরে মাটিতে জলে বা আগুনেই সমৰ্পণ করে দিতে হয় । মানুষের মধ্যে এই দুটি কক্ষ আছে, স্থায়িত্বের এবং অস্থায়িত্বের- অন্তরের' এবং সংসারের। অন্য জন্তুদের মধ্যেও সেটা অস্ফুটভাবে আছে- তেমন গভীরভাবে নেই। সেইজন্যে অন্য জন্তুরা একটা বিপদ থেকে বেঁচে গেছে । তারা, যেটা স্থায়ী নয়, সেটাকে স্থায়ী করবার চেষ্টাও করে না ; কারণ, স্থায়ী করবার উপায় তাদের হাতে নেই । মানুষও অস্থায়ীকে একেবারে চিরস্থায়িত্ব দান করতে পারে না বটে, কিন্তু অন্তরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে তার উপরে স্থায়িত্বের মালমসলা প্রয়োগ করে তাকে যতদিন পারে টিকিয়ে রাখতে ত্রুটি করে না । তার অন্তরপ্রকৃতি নাকি স্থায়িত্বের নিকেতন, এইজন্যেই তার এই সুবিধাটা ঘটেছে। তার ফল হয়েছে এই যে, জন্তুদের মধ্যে যে-সকল প্রবৃত্তি প্রয়োজনের অনুগত হয়ে আপন স্বাভাবিক কর্ম সমাধা করে একেবারে নিরস্ত হয়ে যায়, মানুষ তাকে নিজের অন্তরের মধ্যে নিজের কল্পনার রসে ডুবিয়ে তাকে সঞ্চিত করে রাখে। প্রয়োজনসাধনের সঙ্গে সঙ্গে তাকে মরতে দেয় না। এইজন্যে বাইরে যথাস্থানে যার একটি যথার্থী আছে, অন্তবের মধ্যে সে পাপরাপে স্থায়ী হয়ে বসে। বাইরে যে-জিনিসটা অন্নসংগ্রহচেষ্টারূপে প্রাণ রক্ষা করবার উপায়, তাকেই যদি ভিতরে টেনে নিয়ে সঞ্চিত কর তবে সেইটেই তৃপ্তিহীন ঔদরিকতার নিত্যমূর্তি ধারণ করে স্বাস্থ্যকে নষ্ট করতেই থাকে। তাই দেখতে পাচ্ছি। আমাদের মধ্যে এই নিত্যের নিকেতন, পুণ্যের নিকেতন আছে বলেই আমাদের মধ্যে পাপের স্থান আছে। যা অনিত্য, বিশেষ সাময়িক প্রয়োজনে বিশেষ স্থানে যার প্রয়োগ এবং তার পরে যার শান্তি, তাকেই আমাদের অন্তরের নিত্যনিকেতনে নিয়ে বঁচিয়ে রাখা এবং প্রত্যহই তার অনাবশ্যক খাদ্য জোগানোর জনো ঘুরে মরা, এইটেই হচ্ছে পাপ । পুরাণে বলেছে অমৃত দেবতারই ভোগ্য, তা দৈত্যের খাদ্য নয়। যে দৈত্য চুরি করে সেই অমৃত পান করেছিল তারই মাথাটা রাহু এবং লেজটা কেতু -আকারে বৃথা বেঁচে থেকে নিদারুণ অমঙ্গলরাপে সমস্ত জগৎকে দুঃখ দিচ্ছে। আমাদের যে-অন্তরভাণ্ডার দেবভোগ্য অমৃতের পাত্র রক্ষা করবার আগায়, সেইখানে যদি দৈত্যকে গোপনে প্রবেশ করবার অধিকার দিই, তবে সে চুরি করে অমৃত পান করে অমর হয়ে ওঠে। তারপর থেকে প্রতিদিন সেই বিকট অমঙ্গলটার খোরাক জোগাতে আমাদের স্বাস্থ্য সুখ সম্বল সংগতি নিঃশেষ হয়ে যায়। অমৃতের ভাণ্ডার আছে বলেই আমাদের এই দুৰ্গতি । এই অমৃতের নিত্যনিকেতনে দৈত্যের কোনাে অধিকার নেই বটে, কিন্তু বাহিরে কর্মের ক্ষেত্রে তার প্রয়োজন যথেষ্ট । সে দুৰ্গম পথে ভার বহন করতে পারে, সে পর্বত বিদীর্ণ করে পথ করে দিতে পারে। তাকে দাসের বেতন যদি দাও। তবে সে প্রভুর কাজ উদ্ধার করে দিয়ে কৃতাৰ্থ হয়। কিন্তু অমৃত তো দাসের বেতন নয়, সে যে দেবতার পূজার ভোগসামগ্ৰী।। তাকে অপাত্রে উৎসর্গ করাই পাপ । যাকে যথাকলে বাইরে থেকে মরতে দেওয়াই উচিত, তাকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বঁচিয়ে রাখলেই নিজের হাতে পাপকে সৃষ্টি করা হয় । , তাই বলছিলুম, যেটা বাইরের সেটাকে বাইরে রাখবার সাধনাই জীবনযাত্রার সাধনা। ৫ ফায়ুন ১৩১৫