পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

NტY 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী নয় । কত অভিপ্ৰায় মনে জাগে তার ঠিক নেই। বিদ্যার অভিপ্ৰায়, ধনের অভিপ্ৰায়, খ্যাতির অভিপ্ৰায় প্রভৃতি সকলেই স্ব-সাব-প্রধান হয়ে উঠতে চায়। সেই ইচ্ছার অরাজক বিক্ষিপ্ততাও বাসনাৰ তা ছাড়া আর-একটা জিনিস দেখতে পাই । যখন বাসনার অনুগামী হয়ে বাহিরের সহস্র রাজাকে প্ৰভু করেছিলুম তখন যে বেতন মিলত তাতে তো পেট ভরত না । সেইজন্যেই মানুষ বারংবার আক্ষেপ করে বলেছে বাসনার চাকরি বড়ো দুঃখের চাকরি । এতে যে খাদ্য পাই তাতে ক্ষুধা কেবল বাড়িয়ে তোলে এবং সহস্রের টানে ঘুরিয়ে মেরে কোনো জায়গায় শান্তি পেতে দেয় না । আবার ইচ্ছার অনুগত হয়ে ভিতরের এক-একটি অভিপ্ৰায়ের পশ্চাতে যখন ঘুরে বেড়াই, তখন তো অনেক সময়ে মেকি টাকায় বেতন মেলে । শ্রান্তি আসে, অবসাদ আসে, দ্বিধা আসে। কেবলই উত্তেজনার মদিরার প্রয়োজন হয়- শান্তিরও অভাব ঘটে । বাসনা যেমন বাহিরের ধন্দায় ঘোবায়, এইজন্য, বাসনাগুলোকে ইচ্ছার শাসনাধীনে ঐক্যবদ্ধ করা যেমন মানুষের ভিতরকার কামনা, সেরকম না করতে পারলে সে যেমন কোনো সফলতা দেখতে পায় না, তেমনি ইচ্ছাগুলিকেও কোনো-এক প্রভুর অনুগত করা তার মূলগত প্রার্থনার বিষয় । এ না হলে সে বঁাচে না ! বাহিরের শত্রুকে জয় করবার জন্যে ভিতরের যে সৈন্যদল সে জড়ো করলে, নায়কের অভাবে সেই দুৰ্দান্ত সৈন্যগুলার হাতেই সে মারা পড়বার জো হয় । সৈন্যনায়ক রাজা দসুবিজিত রাজ্যের চেয়ে ভালো বটে, কিন্তু সেও সুখের রাজ্য নয়। তামসিকতায় প্রবৃত্তির প্রাধান্য, রাজসিকতায় শক্তির প্রাধানা— এখানে সৈন্যের রাজত্ব । কিন্তু রাজার রাজত্ব চাই । সেই সরাজকতার পরম কল্যাণ কখন উপভোগ করি ? যখন বিশ্বইচ্ছার সঙ্গে নিজের সমস্ত ইচ্ছাকে সংগত করি । সেই ইচ্ছাই জগতের এক ইচ্ছা, মঙ্গল-ইচ্ছা । সে কেবল আমার ইচ্ছা নয়, কেবল তোমার ইচ্ছা! নয়, সে নিখিলের মূলগত নিতাকালের ইচ্ছা । সেই সকলের প্রভু। সেই এক প্রভুর মহারাজ্যে যখন আমার ইচ্ছার সৈন্যদলকে দাড় করাই, তখনই তারা ঠিক জায়গায় দাড়ায় । তখন ত্যাগে ক্ষতি হয় না, ক্ষমায় বীর্যহানি হয় না, সেবায় দাসত্ব হয় না । তখন বিপদ ভয় দেখায় না, শাস্তি দণ্ড দিতে পারে না, মৃত্যু বিভীষিকা পরিহার করে। একদিন সকলে আমাকে পেয়েছিল, অবশেষে রাজাকে যখন পেলুম তখন আমি সকলকে পেলুম । যে বিশ্ব থেকে নিজের অন্তরের দুৰ্গে আত্মরক্ষার জন্যে প্রবেশ করেছিলুম, সেই বিশ্বেই আবার নির্ভয়ে বাহির হলুম, রাজার ভৃত্যকে সেখানে সকলে সমােদর করে গ্ৰহণ করলে | ১১। ফায়ূন স্বাভাবিকী ক্রিয়া যে এক ইচ্ছা বিশ্বজগতের মূলে বিরাজ করছে তারই সম্বন্ধে উপনিষৎ বলেছেন— স্বাভাবিকী জ্ঞানবিলক্রিয়া চ । সেই একেরই জ্ঞানক্রিয়া এবং বলক্রিয়া স্বাভাবিকী | তা সহজ, তা স্বাধীন, তার উপরে বাইরের কোনো কৃত্রিম তাড়না নেই। আমাদের ইচ্ছা যখন সেই মূল মঙ্গল-ইচ্ছার সঙ্গে সংগত হয়, তখন তারও সমস্ত ক্রিয়া স্বাভাবিকী হয়। অর্থাৎ, তার সমস্ত কাজকে কোনো প্রবৃত্তির তাড়নার দ্বারা ঘটায় না— অহংকার তাকে ঠেলা দেয় না, লোকসমাজের অনুকরণ তাকে সৃষ্টি করে না, লোকের খ্যাতিই তাকে কোনোরকমে জীবিত