পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VOR রবীন্দ্র-রচনাবলী তার পরে তার ভিতরকার যেটি আসল জিনিস, তার আঁটি- যেটিকে বাইরে দেখাই যায় না, তার সঙ্গে তার বাহিরের অংশের একটা বিশ্লিষ্টত ঘটতে থাকে। সেটা যে তার নিত্যপদার্থ নয় তা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে আসে। তার শস্য অংশের সঙ্গে তার ছালটা পৃথক হতে থাকে, ছাল অনায়াসে শাস থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া যায়, আবার তার শাসও আঁটি থেকে সম্পূর্ণ ছাড়িয়ে ফেলা সহজ হয়। তার বেঁটা এতদিন গাছকে আঁকড়ে ছিল, তাও আলগা হয়ে আসে। গাছের সঙ্গে নিজেকে সে আর অত্যন্ত এক করে রাখে না-- নিজের বাহিরের আচ্ছাদনের সঙ্গেও নিজের ভিতরের আঁটিকে সে নিতান্ত একাকার করে থাকে না | সাধক তেমনি যখন নিজের ভিতরে নিজের অমরত্বকে লাভ করতে থাকেন, সেখানটি যখন সুদৃঢ় সুসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে, তখন তীর বাইরের পদার্থটি ক্রমশই শিথিল হয়ে আসতে থাকে- তখন তীর লাভটা হয় ভিতরে, আর দানটা হয় বাইরে । তখন তঁর ভয় নেই, কেননা তখন তীর বাইরের ক্ষতিতে তীর ভিতরের ক্ষতি হয় না। তখন শাসকে আঁটি আঁকড়ে থাকে না ; শািস কাটা পড়লে অনাবৃত আঁটির মৃত্যুদশা ঘটে না। তখন পাখিতে যদি ঠোকরায় ক্ষতি নেই, ঝড়ে যদি আঘাত করে বিপদ নেই, গছ যদি শুকিয়ে যায় তাতেও মৃত্যু নেই | কারণ, ফল তখন আপনি অমরত্বকে আপন অন্তরের মধ্যে নিশ্চিতরূপে উপলব্ধি করে, তখন সে “অতিমৃত্যুমেতি" | তখন সে আপনাকে আপনার নিত্যতার মধ্যেই সত্য বলে জানে, অনিত্যতার মধ্যেই নিজেকে সে নিজে বলে জানে না।— নিজেকে সে শাস বলে জানে না, খোসা বলে জানে না, বেটা বলে জানে না- সুতরাং ঐ শােস খোসা বেঁটার জন্যে তার আর কোনো ভয় ভাবনাই নেই। এই অমৃতকে নিজের মধ্যে বিশেষরূপে লাভ করার অপেক্ষা আছে। সেইজনেই উপনিষৎ বারংবার বলেছেন, অমরতাঁকে লাভ করার একটি বিশেষ অবস্থা আছে– “য এতদবিদ্যুর মৃতন্তে ভবন্তি ।” ভিতরে যখন সেই অমৃতের সঞ্চার হয় তখন অমরাত্মা বাইরেকে আর একান্তরূপে ভোগ করতে চায় না। তখন, তার যা গন্ধ, যা বর্ণ, যা রস, যা আচ্ছাদন, তাতে তার নিজের কোনো প্রয়োজন নেই- সে এ-সমস্তের মধ্যেই নিহিত থেকে একান্ত নির্লিপ্ত, এর ভালোমন্দ তার ভালোমন্দ আর নয়, এর থেকে সে কিছুই প্রার্থনা করে না। তখন ভিতরে সে লাভ করে, বাইরে সে দান করে ; ভিতরে তার দৃঢ়তা, বাইরে তার কোমলতা ; ভিতরে সে নিতাসত্যের, বাইরে সে বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের ; ভিতরে সে পুরুষ, বাইরে সে প্রকৃতি । তখন বাইরে তার প্রয়ােজন থাকে না বলেই পূর্ণভাবে বাইরের প্রয়ােজন সাধন করতে থাকে, তখন সে ফলভোগী পাখির ধর্ম ত্যাগ করে ফলদশী পাখির ধর্ম গ্ৰহণ করে। তখন সে আপনাতে আপনি সমাপ্ত হয়ে নিৰ্ভয়ে নিঃসংকোচে সকলের জন্যে আপনাকে সমর্পণ করতে পারে। তখন তার যা-কিছু সমস্তই তার প্রয়োজনের অতীত, সুতরাং সমস্তই তার ঐশ্বর্য। ২০। ফায়ুন ১৩১৫