পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন や○○ নদীও হয়তো অত্যন্ত কাছে। কিন্তু আমার পাত্র থেকে সেই নদীরই জল এক গণ্ডুষ দিলেও সেটা জল দান করা হল । বনের ফুল তো দেবতার সম্মুখেই ফুটেছে । কিন্তু তাকে আমার ডালিতে সাজিয়ে একবার আমার করে নিলে তবে তার দ্বারা দেবতার পূজা হয়। দেবতাও তখন হেসে বলেন, হী, তোমার ফুল পেলুম । সেই হাসিতেই আমার ফুল তোলা সার্থক হয়ে যায়। অহং আমাদের সেই ঘট, সেই ডালি । তার বেষ্টনের মধ্যে যা এসে পড়ে তাকেই “আমার বলবার অধিকার জন্মায়- একবার সেই অধিকারটি না জন্মালে দানের অধিকার জন্মে না । তবেই দেখা যাচ্ছে, অহং-এর ধর্মই হচ্ছে সংগ্ৰহ করা, সঞ্চয় করা। সে কেবলই নেয়। পেলুম বলে যতই তার গৌরব বোধ হয় ততই তার নেবার আগ্রহ বেড়ে যায়। অহং-এর যদি এইরকম সব জিনিসেই নিজের নাম নিজের সীলমোহর চিহ্নিত করবার স্বভাব না থাকত, তা হলে আত্মার যথার্থ কাজটি চলত না, সে দরিদ্র এবং জড়বৎ হয়ে থাকত । কিন্তু অহং-এর এই নেবার ধর্মটিই যদি একমাত্র হয়ে ওঠে, আত্মার দেবার ধর্ম যদি আচ্ছন্ন হয়ে যায়, তবে কেবলমাত্র নেওয়ার লোলুপতার দ্বারা আমাদের দারিদ্র্য বীভৎস হয়ে দাঁড়ায় । তখন আত্মাকে আর দেখা যায় না, অহংটাই সর্বত্র ভয়ংকর হয়ে প্রকাশ পায় । তখন আমার আনন্দময়স্বরূপ কোথায় ? তখন কেবল ঝগড়া, কেবল কান্না, কেবল ভয়, কেবল ভাবনা ৷ তখন ডালির ফুল নিয়ে আত্মা পূজা করতে পায় না। অহং বলে ”এ সমস্তই আমি নিলুম' । সে মনে করে ‘আমি পেয়েছি । কিন্তু ডালির ফুল তো বনের ফুল নয় যে, কখনো ফুরোবে না, নিতাই নূতন নূতন করে ফুটবে । পেলুম বলে যখন সে নিশ্চিন্ত হয়ে আছে ফুল তখন শুকিয়ে যাচ্ছে। দুদিনে সে কালো হয়ে গুড়িয়ে ধুলো হয়ে যায়, পাওয়া একেবারে ফাকি হয়ে যায়। তখন বুঝতে পারি পাওয়া জিনিসটা, নেওয়া জিনিসটা, কখনোই নিত্য হতে পারে না। আমরা পাব, নেব, আমার করব, কেবল দেওয়ার জন্য । নেওয়াটা কেবল দেওয়ারই উপলক্ষ- অহংটা কেবল অহংকারকে বিসর্জন করতে হবে বলেই । নিজের দিকে একবার টেনে আনিব বিশ্বের দিকে উৎসর্গ করবার অভিপ্ৰায়ে। ধনুকে তীর যোজনা করে প্রথমে নিজের দিকে তাকে যে আকর্ষণ করি, সে তো নিজেকে বিদ্ধ করবার জন্যে নয়, সম্মুখেই তাকে ক্ষেপণ করবার জন্যে । তাই বলছিলুম অহং যখন তার নিজের সঞ্চয়গুলি এনে আত্মার সম্মুখে ধরবে তখন আত্মাকে বলতে হবে, 'না, ও আমার নয়, ও আমি নেব না। ও সমস্তই বাইরে রাখতে হবে, বাইরে দিতে হবে, ওর এক কণাও আমি ভিতরে তুলব না ।” অহং-এর এইসমস্ত নিরন্তর সঞ্চায়ের দ্বারা আত্মাকে বদ্ধ হয়ে থাকলে চলবে না । কারণ এই বদ্ধতা আত্মার স্বাভাবিক নয়, আত্মা দানের দ্বারা মুক্ত হয়। পরমাত্মা যেমন সৃষ্টির দ্বারা বদ্ধ নন, তিনি সৃষ্টির দ্বারাই মুক্ত, কেননা তিনি নিচ্ছেন না, তিনি দিচ্ছেন, আত্মাও তেমনি অহং-এর রচনা-দ্বারা বদ্ধ হবার জন্যে হয় নি, এই রচনাগুলি-দ্বারাই সে মুক্ত হবে, তার আনন্দস্বরূপ মুক্ত হবে, কারণ এইগুলিই সে দান করবে। এই দানের দ্বারাই তার যথার্থ প্রকাশ । ঈশ্বরেরও আনন্দরূপ অমৃতরূপ বিসর্জনের দ্বারাই প্রকাশিত। সেইজন্য অহং তখনই আত্মার যথার্থ প্রকাশ হয়, যখন আত্মা তাকে উৎসর্গ করে দেয়, আত্মা তাকে নিজেই গ্ৰহণ না করে । v 瓦西