পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন VO) ভূম বুদ্ধকে যখন মানুষ জিজ্ঞাসা করলে, কোথায় থেকে এই সমস্ত হয়েছে, আমরা কোথা থেকে এসেছি, আমরা কোথায় যাব ; তখন তিনি বললেন, “তোমার ও-সব কথায় কাজ কী ? আপাতত তোমার যেটা অত্যন্ত দরকার সেইটোতে তুমি মন দাও । তুমি বড়ো দুঃখে পড়েছি, তুমি যা চাও তা পাও না, যা পাও তা রাখতে পারো না, যা রাখা তাতে তোমার আশা মেটে না । এই নিয়ে তোমার দুঃখের অবধি নেই। সেইটে মেটাবার উপায় করে তবে অন্য কথা।' এই বলে দুঃখনিবৃত্তিকেই তিনি পরম লক্ষ্য বলে, তার থেকে মুক্তির পথে আমাদের ডাক দিলেন। কিন্তু কথা এই যে, একান্ত দুঃখনিবৃণ্ডিকেই তো মানুষ পরম লক্ষ্য বলে ধরে নিতে পারে না । সে যে তার স্বভাবই নয়। আমি যে স্পষ্ট দেখছি দুঃখকে অঙ্গীকার করে নিতে সে আপত্তি করে না। অনেক সময় গায়ে পড়ে সে দুঃখকে বরণ করে নেয়। আলপস পর্বতের দুৰ্গম শিখরের উপর একবার কেবল পদার্পণ করে আসবার জন্যে প্রাণপণ করা তার পক্ষে সম্পূর্ণ অনাবশ্যক, কিন্তু বিনা কারণে মানুষ সেই দুঃখ স্বীকার করতে প্রস্তুত হয়। এমন দৃষ্টান্ত ঢের আছে। তার কারণ কী ? তার কারণ এই যে, দুঃখের সম্বন্ধে মানুষের একটা স্পর্ধা আছে। ‘আমি দুঃখ সইতে পারি, আমার মধ্যে সেই শক্তি আছে- এ কথা মানুষ নিজেকে এবং অন্যকে জানাতে চায়। আসল কথা, মানুষের সকলের চেয়ে সত্য ইচ্ছা হচ্ছে বড়ো হবার ইচ্ছ, সুখী হবার ইচ্ছা নয়। আলেকজান্ডারের হঠাৎ ইচ্ছা হল দুৰ্গম নদী গিরি মরু সমুদ্র পার হয়ে দিগ্বিজয় করে আসবেন। রাজসিংহাসনের আরাম ছেড়ে এমন দুঃসহ দুঃখের ভিতর দিয়ে তাকে পথে পথে ঘোরায় কে ? ঠিক রাজ্যলোভ নয়, বড়ো হবার ইচ্ছা— বড়ো হওয়ার দ্বারা নিজের শক্তিকে বড়ো করে উপলব্ধি করা। এই অভিপ্ৰায়ে মানুষ কোনো দুঃখ থেকে নিজেকে ধাচাতে চায় না। যে লোক লক্ষপতি হবে বলে দিন রাত টাকা জমাচ্ছে- বিশ্রামের সুখ নেই, খাবার সুখ নেই, রাত্রে ঘুম নেই, লাভক্ষতির নিরন্তর আন্দােলনে মনে চিন্তার সীমা নেই- সে কী জন্যে এই অসহ্য কষ্ট স্বীকার করে নিয়েছে ? ধােনর পথে যতদূর সম্ভব বড়ো হয়ে ওঠবার জন্যে। তাকে এ কথা বলা মিথ্যা যে, “তোমাকে দুঃখনিবারণের পথ বলে দিচ্ছি।” তাকে এ কথাও বলা মিথ্যা যে, ‘ভোগের বাসনা ত্যাগ করো, আরামের আকাঙক্ষা মনে রেখে না।” ভোগ এবং আরাম সে যেমন ত্যাগ করেছে এমন আর কে করতে পারে । বুদ্ধদেব যে দুঃখনিবৃত্তির পথ দেখিয়ে দিয়েছেন, সে পথের একটা সকলের চেয়ে বড়ো আকর্ষণ কী ? সে এই যে, অত্যন্ত দুঃখ স্বীকার করে এই পথে অগ্রসর হতে হয়। এই দুঃখগ্ৰীকারের দ্বারা মানুষ আপনাকে বড়ো করে জানে। খুব বড়োরকম করে ত্যাগ, খুব বড়োরকম করে ব্ৰতপালনের মহাত্ম্য মানুষের শক্তিকে বড়ো করে দেখায় বলে মানুষের মন তাতে ধাবিত হয়। এই পথে অগ্রসর হয়ে যদি সত্যিই এমন কোনো একটি জায়গায় মানুষ ঠেকতে পারত যেখানে একান্ত দুঃখনিবৃত্তির শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই নেই, তা হলে ব্যাকুল হয়ে তাকে জগতে দুঃখের সন্ধানে বেরোতে হত । অতএব মানুষকে যখন বলি দুঃখনিবৃত্তির উদ্দেশে তোমাকে সমস্ত সুখের বাসনা ত্যাগ করতে হবে তখন সে রাগ করে বলতে পারে চাই নে আমি দুঃখনিবৃত্তি । ওর চেয়ে বড়ো কিছু একটাকে দিতে হবে, কারণ মানুষ বড়োকেই চায়। সেইজন্যে উপনিষৎ বলেছেন : ভূমৈব সুখং । অর্থাৎ সুখ সুখই নয়, বড়োই সুখ। বিজিজ্ঞাসিতব্যঃ । এই বড়োকেই জানতে হবে, ঐকেই পেতে হবে। এই কথাটির তাৎপর্যযদি বুঝি তা হলে কখনােই বলি নে যে, চাই নে তোমার বড়োকে ।