পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন Ꮤ2Ꮤ2Ꮤ) পায় । এইজন্যই পরমাত্মাকে "একান্তপ্রত্যয়সারং” বলা হয়েছে। অর্থাৎ নিজের প্রতি আত্মার যে একটি সহজ প্রত্যয় আছে সেই প্রত্যায়েরই সার হচ্ছেন তিনি । আমাদের আত্মা যে স্বভাবতই নিজেকে এক বলে জানে, সেই এক জানারই সার হচ্ছে পরম এককে জানা | তেমনি আমাদের যে একটি আত্মপ্রেম আছে, আত্মাতে আত্মার আনন্দ, এই আনন্দই হচ্ছে মানবাত্মার প্রতি প্রেমের ভিত্তি, বিশ্বাত্মার প্রতি প্রেমের ভিত্তি, পরমাত্মার প্রতি প্রেমের ভিত্তি । অর্থাৎ এই আত্মপ্রেমেরই পরিপূর্ণতম সত্যতম বিকাশ হচ্ছে পরমাত্মার প্রতি প্ৰেম— সেই ভূমানন্দেই আত্মার আনন্দের পরিণতি । আমাদের আত্মপ্রমের চরম সেই পরমাত্মায় আনন্দ ৷ তদেতং প্ৰেয়ঃ পুত্রাৎ প্রেয়ো বিত্তাং প্রেয়োহনাত্মাৎ সর্বস্মাৎ অন্তরতর যদীয়মাত্মা | S Š ፲b፴ ধীর যুক্তাত্মা এই কথাটিকে আলোচনা করে কেবল কঠিন করে তোলা হচ্ছে। অথচ এইটিই আমাদের সকলের চেয়ে সহজ কথা— একেবারে গোড়াকার প্রথম কথা এবং শেষের শেষ কথা । আমরা নিজের মধ্যে একটি এক পেয়েছি এবং এককেই আমরা বহুর মধ্যে সর্বত্রই খুঁজে বেড়াচ্ছি। এমন-কি, শিশু যখন নানা জিনিসকে ছুয়ে শুকে খেয়ে দেখবার জন্যে চারি দিকে হাত বাড়াচ্ছে তখনো সে সেই এককেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমরাও শিশুরই মতো নানা জিনিসকে ছুচ্ছি, শুকছি, মুখে দিচ্ছি, তাকে আঘাত করছি, তার থেকে আঘাত পাচ্ছি, তাকে জমাচ্ছি এবং তাকে আবর্জনার মতো ফেলে দিচ্ছি। এইসমস্ত পরীক্ষা এই-সমস্ত চেষ্টার ভিতর দিয়ে সমস্ত দুঃখে সমস্ত লাভে আমরা সেই এককেই চাচ্ছি। আমাদের জ্ঞান একে পীেছোতে চায়, আমাদের প্ৰেম একে মিলতে চায় ! এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো কথা (r. আনন্দাদ্ধোব খন্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে । আনন্দ আপনাকে নানারূপে নানাকালে প্রকাশ করছেন, আমরা সেই নানারূপকেই কেবল দেখছি, কিন্তু আমাদের আত্মা দেখতে চায় নানার ভিতর দিয়ে সেই মূল এক আনন্দকে ৷ যতক্ষণ সেই মূল আনন্দের কোনো আভাস না দেখি ততক্ষণ কেবলই বস্তুর পর বস্তু— ঘটনার পর ঘটনা আমাদের ক্লান্ত করে, ক্লিষ্ট করে, আমাদের অন্তহীন পথে ঘুরিয়ে মারে । আমাদের বিজ্ঞান সমস্ত বস্তুর মধ্যে এক সত্যকে খুঁজছে, আমাদের ইতিহাস সমস্ত ঘটনার মধ্যে এক অভিপ্ৰায়কে খুঁজছে, আমাদের প্রেম সমস্ত সত্তার মধ্যে এক আনন্দকে খুঁজছে। নইলে সে কোনোখানেই বলতে পারছে না- ওঁ । বলতে পারছে না- হাঁ, পাওয়া গেল । আমরা যখন একটা অন্ধকার ঘরে আমাদের প্রার্থনীয় বস্তুকে খুঁজে বেড়াই তখন চারি দিকে মাথা বহুমূল্য বলে মনে করি, কত জিনিসকে আঁকড়ে ধরে বলি এই তো পেয়েছি। — তার পরে দেখি মুঠোর মধ্যেই সেটা গুড়িয়ে ধুলো হয়ে যায়। আসল কথা, এই অন্ধকারে আমি জানিই নে আমি কাকে চাচ্ছি। কিন্তু যেমনি একটি আলো জ্বালা হয় অমনি এক মুহুর্তেই সমস্ত সহজ হয়ে যায়- অমনি এতদিনের এত খোজা, এত মাথা ঠোকার পরে এক পলকেই জানতে পারি যে, যা সমস্ত আমার হাতে ঠেকছিল তাই আমার প্রার্থনীয় জিনিস নয়। যে মা এই সমস্ত ঘরটি সাজিয়ে চুপ করে বসেছিলেন তিনিই আমার যথার্থ কামনার ধন। যেমনি আলোটি জ্বলল অমনি সব জিনিস ছেড়ে দু-হাত বাড়িয়ে ছুটে তীর কাছে গেলুম। অথচ মাকে পাবামাত্রই অমনি তীর সঙ্গে সব জিনিসকেই একত্রে পাওয়া গেল, কোনো জিনিস স্বতন্ত্র হয়ে আমার পথের বাধারূপে আমাকে আটক করলে না । মাকে জানাবামাত্র মায়ের এই সাজানো ঘরটি আমারই হয়ে গেল। তখন ঘরের সমস্ত আসবাবপত্রের মধ্যে আমার সঞ্চরণ অবাধ হয়ে উঠল,