পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন \ტ\ტ(Y নিজেকে নিয়মের পথে দৃঢ় করে ধরে রাখবার সাধনা অনেক জায়গায় দেখা যায়, কিন্তু নিজেকে । তীর হাতে সমর্পণ করে দেবার সাধনা অল্পই দেখতে পাই। এখানেও মানুষের যেন একটা কৃপণতা আছে । সে নিজেকে নিজের হাতে রাখতে চায় ছাড়তে চায় না । একটা কোনো কঠোর ব্ৰতে সে প্রতিদিন নিজের শক্তির পরিচয় পায়। প্রতিদিন একটা হিসাব পেতে থাকে যে, নিয়ম দৃঢ় রেখে এতখানি চলা হল । এতেই তার একটা বিশেষ অভিমানের আনন্দ আছে । নিজের জীবনকে ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করে দেবার এ মানে নয় যে, আমি যা করছি সমস্তই তিনি করছেন এইটি কল্পনা করা । করছি কাজ আমি, অথচ নিচ্ছি। তঁর নাম, এবং দায়িক করছি তাকেএমন দুর্বিপাক না যেন ঘটে । ঈশ্বরের হাওয়ার কাছে জীবনটাকে একেবারে ঠিক করে ধরে রাখতে হবে । সেটিকে সম্পূর্ণ মানতে হবে। কান্ত হয়ে সেটিকে পাশ কাটিয়ে চললে হবে না। তার আহবান তীর প্রেরণাকে পুরাপুরি গ্রহণ করবার মুখে জীবন প্রতিমুহূর্তে যেন আপনাকে প্রসারিত করে রাখে। “কী ইচ্ছা, প্ৰভু, কী আদেশ” এই প্রশ্নটিকে জাগ্রত করে রেখে সে যেন সর্বদা প্রস্তুত হয়ে থাকে। যা শ্রেয় তা যেন সহজেই তাকে চালায় এবং শেষ পর্যন্তই তাকে নিয়ে যায় । , জানামি ধর্মং ন চ মে প্রবৃত্তিঃ জানামধৰ্মং ন চ মে নিবৃত্তিঃ । তুয়া হৃষীকেশ হৃদিস্থিতেন যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি। এ শ্লোকের মানে এমন নয় যে, আমি ধর্মেই থাকি আর অধৰ্মেই থাকি তুমি আমাকে যেমন চালােচ্ছ আমি তেমনি চলছি। এর ভাব এই যে, আমার প্রবৃত্তির উপরেই যদি আমি ভার দিই। তবে সে আমাকে ধর্মের দিকে নিয়ে যায় না, অধর্ম থেকে নিরস্ত করে না ; তাই হে প্ৰভু, স্থির করেছি। তোমাকেই আমি হৃদয়ে রাখব এবং তুমি আমাকে যে দিকে চালাবে সেই দিকে চলব। স্বাৰ্থ আমাকে যে দিকে চালাতে চায় সে দিকে চলাব না, অহংকার আমাকে যে পথ থেকে নিবৃত্ত করতে চায় আমি সে পথ থেকে নিবৃত্ত হব না । অতএব তাকে হৃদয়ের মধ্যে স্থাপিত করে তার হাতে নিজের ভার সমর্পণ করা, প্রত্যহ আমাদের ইচ্ছাশক্তির এই একটিমাত্ৰ সাধনা হােক । এইটি করতে গেলে গোড়াতেই অহংকারকে তার চূড়ার উপর থেকে একেবারে নামিয়ে আনতে হবে । পৃথিবীর সকলের সঙ্গে সমান হও, সকলের পিছনে এসে দাড়াও, সকলের নীচে গিয়ে বোসে, তাতে কোনো ক্ষতি নেই। তোমার দীনতা ঈশ্বরের প্রসাদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক, তোমার নম্রতা সুমধুর অমৃতফলভারে সার্থক হােক। সর্বদা লড়াই করে নিজের জন্যে ঐ একটুখানি স্বতন্ত্র জায়গা বঁচিয়ে রাখবার কী দরকার, তার কী মূল্য ? জগতের সকলের সমান হয়ে বসতে লজ্জা কোরো নাসেইখানেই তিনি বসে আছেন। যেখানে সকলের চেয়ে উঁচু হয়ে থাকবার জন্যে তুমি একলা বসে আছ সেখানে তঁর স্থান অতি সংকীর্ণ। যতদিন তীর কাছে আত্মসমর্পণ না করবে ততদিন তোমার হার-জিত তোমার সুখদুঃখ ঢেউয়ের মতো কেবলই টলাবে, কেবলই ঘোরাবে। প্রত্যেকটা পুরো আঘাত তোমাকে নিতে হবে । যখন তোমার পালে তার হাওয়া লাগবে তখন তরঙ্গ সমােনই থাকবে, কিন্তু তুমি হু হু করে চলে যাবে। তখন সেই তরঙ্গ আনন্দের তরঙ্গ । তখন প্ৰত্যেক তরঙ্গটি কেবল তোমাকে নমস্কার করতে থাকবে এবং এই কথাটিরই প্রমাণ দেবে যে, তুমি তীকে আত্মসমৰ্পণ করেছ। তাই বলছিলুম জীবনযাত্রার সাধনায় নিজের শক্তির চর্চা যতই করি, ঈশ্বরের চিরপ্রবাহিত অনুকুল দক্ষিণ বায়ুর কাছে সমস্ত পালগুলি একেবারেই পূর্ণভাবে ছড়িয়ে দেবার কথাটা না ভুলি যেন। २8 (bdी