পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Web SR রবীন্দ্র-রচনাবলী । মরে যায়, যা ফুরিয়ে যায়, তাতে আমাদের আনন্দ নেই- যেখানে আমরা সীমার মধ্যে অসীমকে দেখি, অমৃতকে দেখি, সেখানেই আমাদের আনন্দ । এই অসীমই সত্য- তাকে দেখাই সত্যকে দেখা । যেখানে তা না দেখবে সেইখানেই বুঝতে হবে আমাদের নিজের জড়তা মূঢ়তা অভ্যাস ও সংস্কারের দ্বারা আমরা সত্যকে অবরুদ্ধ করেছি, সেইজন্যে তাতে আমরা আনন্দ পাচ্ছি নে । বৈজ্ঞানিক বলো, দার্শনিক বলো, কবি বলো, তাদের কাজই মানুষের এই সমস্ত মুঢ়তা ও অভ্যাসের আবরণ মোচন করে এই জগতের মধ্যে সত্যের অনন্তরূপকে দেখানো, যা-কিছু দেখছি। একেই সত্য করে দেখানো, নূতন কিছু তৈরি করা নয়, কল্পনা করা নয়। এই সত্যকে মুক্ত করে দেখানের মানেই হচ্ছে মানুষের আনন্দের অধিকার বাড়িয়ে দেওয়া । যেমন ঘর ছেড়ে দিয়ে কোনো দূরদেশে যাওয়াকে অন্ধকারমুক্তি বলে না, ঘরের দরজাকে খুলে দেওয়াই বলে অন্ধকার-মোচন, তেমনি জগৎসংসারকে ত্যাগ করাই মুক্তি নয়- পাপ স্বাৰ্থ অহংকার জড়তা মুঢ়তা ও সংস্কারের বন্ধন কাটিয়ে, যা দেখছি। একেই সত্য করে দেখা, যা করছি একেই সত্য করে করা, যার মধ্যে আছি। এরই মধ্যে সত্য করে থাকাই মুক্তি । যদি এই কথাই সত্য হয় যে, ব্ৰহ্ম কেবল আপনার অব্যক্তস্বরূপেই আনন্দিত তা হলে তার সেই অব্যক্তস্বরূপের মধ্যে বিলীন না হলে নিরানন্দের হাত থেকে আমাদের কোনোক্রমেই নিস্তার থাকত না । কিন্তু তা তো নয়, প্রকাশেই যে তার আনন্দ । নইলে এই জগৎ তিনি প্ৰকাশ করলেন কেন ? পদাৰ্থ ব্ৰহ্মকে একেবারে অভিভূত করে নিজেকে প্রকাশমান করেছে ? সে তো হতেই পারে না । তাই উপনিষৎ বলেছেন, আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি, এই যে প্রকাশমান জগৎ এ আর কিছু নয়, তার মৃত্যুহীন আনন্দই রূপধারণ করে প্রকাশ পাচ্ছে। আনন্দই তীর প্রকাশ, প্ৰকাশেই তার আনন্দ । * তিনি যদি প্রকাশেই আনন্দিত। তবে আমি কি আনন্দের জন্যে অপ্রকাশের সন্ধান করব । তার যদি ইচ্ছাই হয় প্রকাশ, তবে আমার এই ক্ষুদ্র ইচ্ছােটুকুর দ্বারা আমি তার সেই প্রকাশের হাত এড়াই বা কেমন করে ? - তীর আনন্দের সঙ্গে যোগ না দিয়ে আমি কিছুতেই আনন্দিত হতে পারব না। এর সঙ্গে যেখানেই আমার যোগ সম্পূর্ণ হবে সেইখনেই আমার মুক্তি হবে, সেইখনেই আমার আনন্দ হবে । বিশ্বের মধ্যে তীর প্রকাশকে অবাধে উপলব্ধি করেই আমি মুক্ত হব।— নিজের মধ্যে তার প্রকাশকে অবাধে দীপ্যমান করেই আমি মুক্ত হব । ভববন্ধন অর্থাৎ হওয়ার বন্ধন ছেদন করে মুক্তি নয়— হওয়াকেই বন্ধনস্বরূপ না করে মুক্তিস্বরূপ করাই হচ্ছে মুক্তি । কর্মকে পরিত্যাগ করাই মুক্তি নয়, কর্মকে আনন্দােদ্ভব কর্ম করাই মুক্তি । তিনি যেমন আনন্দ প্রকাশ করছেন তেমনি আনন্দেই প্রকাশকে বরণ করা, তিনি যেমন আনন্দে কর্ম করছেন তেমনি আনন্দেই কর্মকে গ্রহণ করা, একেই বলি মুক্তি । কিছুই বর্জন না করে প্রতিদিনের এই যে অভ্যন্ত পৃথিবী আমার কাছে জীর্ণ, অভ্যস্ত প্ৰভাত আমার কাছে স্নান, কবে এরাই আমার কাছে নবীন ও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ? যেদিন প্রেমের দ্বারা আমার চেতনা নবশক্তিতে জাগ্রত হয় । যাকে ভালোবাসি আজ তার সঙ্গে দেখা হবে এই কথা স্মরণ হলে কাল যা কিছু শ্ৰীহীন ছিল আজ সেই সমস্তই সুন্দর হয়ে ওঠে । প্রেমের দ্বারা চেতনা যে পূর্ণশক্তি লাভ করে সেই পূর্ণতার দ্বারাই সে সীমার মধ্যে অসীমকে, রূপের মধ্যে অরূপকে, দেখতে পায় ; তাকে নূতন কোথাও যেতে হয় না। ঐ অভাবটুকুর দ্বারাই অসীম সত্য তার কাছে সীমায় বদ্ধ হয়ে ছিল। বিশ্ব তীরে আনন্দরূপ ; কিন্তু আমরা রূপকে দেখছি আনন্দকে দেখছি নে, সেইজন্যে রূপ কেবল পদে পদে আমাদের আঘাত করছে। আনন্দকে যেমনি দেখব অমনি কেউ আর আমাদের কোনো বাধা দিতে পারবে না । সেই তো মুক্তি । r