পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন V2br(? আশ্রম শান্তিনিকেতনের বাৎসরিক উৎসব উপলক্ষে প্রভাতের সূর্য যে উৎসবদিনটির পদ্মদলগুলিকে দিকে দিকে উদঘাটিত করে দিলেন তারই মর্মকোষের মধ্যে প্রবেশ করবার জন্যে আজ আমাদের আহবান আছে। তার স্বর্ণরেণুর অন্তরালে যে মধু সঞ্চিত আছে, সেখান থেকে কি কোনো সুগন্ধ আজ আমাদের হৃদয়ের মাঝখানে এসে পীেছোয় নি ? এই বিশ্ব-উপবনের রহস্য-নিলয়ের ভিতরটিতে প্রবেশের সহজ অধিকার আছে যার, সেই চিত্তমধুকর কি আজও এখনো জাগল না ? কোনো বাতাসে এখনো সে কি খবর পায় নি ? আজকের দিন যে একটি অনেক দিনের খবর নিয়ে বেরিয়েছে এবং সে যে সম্মুখের অনেক দিনের দিকেই চলেছে। সে যে দূর ভবিষ্যতের পথিক । আজ তাকে ধরে দাড় করিয়ে আমাদের প্রশ্ন করতে হবে, তার যা-কিছু কথা আছে সমস্ত আদায় করে নেওয়া চাই । সমস্ত মন দিয়ে না জিজ্ঞাসা করলে সে কাউকে কিছুই বলে না, তখন আমরা মনে করি।-- এই গান, এই বাদ্যধ্বনি, এই জনতার কোলাহল, এই বুঝি তার যা ছিল সমস্ত, আর বুঝি তার কোনো বাণী নেই। কিন্তু এমন করে তাকে যেতে দেওয়া হবে না, আজ এই সমস্ত কোলাহলের মধ্যে যে নিস্তব্ধ হয়ে আছে সেই পথিকটিকে জিজ্ঞাসা করে-- আজি এ কিসের উৎসব ? প্ৰতি বৎসর বসন্তে আমের বনে ফলভরা শাখার মধ্যে দক্ষিণের বাতাস বইতে থাকে, সেই সময়ে আমের বনে তার বার্ষিক উৎসবের ঘটা । কিন্তু এই উৎসবের উৎসবত্ব কী নিয়ে, কিসের জনো ? না, যে বীজ থেকে আমের গাছ জন্মেছে সেই বীজ অমর হয়ে গেছে এই শুভ খবরটি দেবার জন্যে । বৎসরে বৎসরে ফল ধরছে, সে ফলের মধ্যে সেই একই বীজ, সেই পুরাতন-বীজ। সে আর কিছুতেই ফুরোচ্ছে না, সে নিতাকালের পথে নিজেকে দ্বিগুণিত চতুরগুণিত সহস্ৰগুণিত করে চলেছে। শান্তিনিকেতনের সাম্বাৎসরিক উৎসবের সফলতার মর্মস্থান যদি উদঘাটন করে দেখি তবে দেখতে পাব এর মধ্যে সেই বীজ অমর হয়ে আছে যে বীজ থেকে এই আশ্রম-বিনস্পতি জন্মলাভ করেছে। সে হচ্ছে সেই দীক্ষাগ্রহণের বীজ | মহৰ্ষির সেই জীবনের দীক্ষা এই আশ্রম-বনস্পতিতে আজ আমাদের জন্যে ফলছে এবং আমাদের আগামীকালের উত্তরবংশীয়দের জন্যে ফলতেই চলবে । বহুকাল পূর্বে কোন একদিনে মহর্ষি দীক্ষাগ্ৰহণ করেছিলেন, সে খবর কজন লোকই বা জানত ? যারা জেনেছিল, যারা দেখেছিল, তারা মনে মনে ঠিক করেছিল এই একটি ঘটনা আজকে ঘটল এবং আজকেই এটা শেষ হয়ে গেল । কিন্তু এই দীক্ষাগ্ৰহণ ব্যাপারটিকে সেই সুদূর কালের ৭ই পৌষ নিজের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নিঃশেষ করে ফেলতে পারে নি। সেই একটি দিনের মধ্যেই একে কুলিয়ে উঠল না। সেদিন যার খবর কেউ পায় নি এবং তার পরে বহুকাল পর্যন্ত যার পরিচয় পৃথিবীর কাছে অজ্ঞাত ছিল, সেই ৭ই পৌষের দীক্ষার দিন আজ অমর হয়ে বৎসরে বৎসরে উৎসবফল প্রসব করছে। আমাদের জীবনে কত শত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, কিন্তু চিরপ্রাণ তো তাদের স্পর্শ করে না ; তারা নিজের অদৃশ্য চিহ্নটি লিখে দিয়ে চলে যান, তার পরে তাকে কেউ না দেখুক, না জানুক, সে হেলায় ফেলায় পড়ে থাক, তাকে আবর্জনা বলে লোকে বেঁটিয়ে ফেলুক, সেদিনকার এবং তার পরে বহুদিনকার ইতিহাসের পাতে তার কোনাে উল্লেখ না থাকুক, কিন্তু সে রয়ে গেল। জগতের রাশি রাশি। মৃত্যু ও বিস্মৃতির মাঝখান থেকে সে আপনার অন্ধুরটি নিয়ে অতি অনায়াসে মাথা তুলে ওঠে, নিত্যকালের সূর্যালােক এবং নিত্যকালের সমীরণ তাকে পালন করবার ভার গ্রহণ করে, সদাচঞ্চল সংসারের ভয়ংকর ঠেলাঠেলিতেও তাকে আর সরিয়ে ফেলতে পারে না । ।