পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Wobrや রবীন্দ্র-রচনাবলী মহৰ্ষির জীবনের একটি ৭ই পৌষকে সেই প্রাণস্বরূপ অমৃতপুরুষ একদিন নিঃশব্দে স্পর্শ করে গিয়েছেন, তার উপরে আর মৃত্যুর অধিকার রইল না। সেই দিনটি তীর জীবনের সমস্ত দিনকে ব্যাপ্ত করে কিরকম করে প্রকাশ পেয়েছে তা কারও অগোচর নেই। তার পরে তার দীর্ঘ জীবনের মধ্যেও সেই দিনটির শেষ হয় নি। আজও সে বেঁচে আছে- শুধু বেঁচে নেই, তার প্রাণশক্তির বিকাশ ক্রমশই প্রবলতর হয়ে উঠছে। পৃথিবীতে আমরা অধিকাংশ লোকই প্রচ্ছন্ন হয়ে আছি। আমাদের মধ্যে সেই প্রকাশ নেই যে-প্রকাশকে ঋষি আহবান করে বলেছেন ; আবিরাবীর্ম এধি— হে প্ৰকাশ, তুমি আমাতে প্রকাশিত হও । তার সেই প্রকাশ যার জীবনে আবির্ভূত তিনি তো আর নিজের ঘরের প্রাচীরের দ্বারা নিজেকে আড়াল করে রাখতে পারেন না এবং তিনি নিজের আয়ুটুকুর মধ্যেই নিজে সমাপ্ত হয়ে থাকেন না । নিজের মধ্যে থেকে তাকে সর্বদেশে এবং নিত্যকালে বাহির হতেই হবে । সেইজন্যেই উপনিষৎ दळश्या যদৈতম অনুপশ্যতি আত্মানং দেবম অঞ্জস্যা ঈশানং ভূতভাব্যস্য ন ততো বিজুগুন্সতে । যখন এই দেবতাকে, এই পরমাত্মাকে, এই ভূতভবিষ্যতের ঈশ্বরকে কোনো ব্যক্তি সাক্ষাৎ দেখতে পান তখন তিনি আর গোপনে থাকতে পারেন না । র্তাকে যিনি সাক্ষাৎ দেখেছেন, অর্থাৎ একেবারে নিজের অন্তরাত্মার মাঝখানেই দেখেছেন, তার আর পর্দা নেই, দেয়াল নেই, প্রাচীর নেই । তিনি সমস্ত দেশের, সমস্ত কালের । তার কথার মধ্যে, আচরণের মধ্যে, নিত্যতার লক্ষণ আপনিই প্ৰকাশ পেতে থাকে । এর কারণ কী ? এর কারণ হচ্ছে এই যে, তিনি যে আত্মানং, সকল আত্মার আত্মাকে দেখেছেন । যারা সেই আত্মাকে দেখে নি তারা অহংকেই বড়ো করে দেখে । তারা বাহিরের দরজার কাছেই ঠেকে গিয়েছে। তারা কেবল আমার খাওয়া আমার পরা, আমার বুদ্ধি আমার মত, আমার খ্যাতি আমার । বিত্ত- একেই প্রধান করে দেখে । এই-যে অহংকার এতে সত্য নেই, নিত্য নেই ; এ আলোকের দ্বারা নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না, আঘাতের দ্বারা প্রকাশ করতে চেষ্টা করে । কিন্তু যে-লোক আত্মাকে দেখেছে সে আর অহং-এর দিকে দৃকপাত করতে চায় না। তার সমস্ত ং-এর আয়োজন পুড়ে ছাই হয়ে যায়। যে-প্রদীপে আলোকের শিখ ধরে নি। সেই তো নিজের প্রচুর তেল ও পলতের সঞ্চয় নিয়ে গর্ব করে । আর যাতে আলো একবার ধরে গিয়েছে সে কি আর নিজের তেল পলতের দিকে ফিরে তাকয় ? সে ঐ আলোটির পিছনে তার সমস্ত তেল সমস্ত পলতে উৎসর্গ করে দেয়। কিন্তু সে একেবারে প্রকাশ হয়ে পড়ে, সে আর নিজের আড়ালে গোপনে থাকতে পারে না। ন ততো বিজুগুল্পতে । কেন ? কেননা তিনি অনুপশ্যতি আত্মানং দেবং । তিনি আত্মাকে দেখেছেন, দেবকে দেখেছেন । দেব শব্দের অর্থ দীপ্তিমান | আত্মা যে দেব, আত্মা যে জ্যোতির্ময় । আত্মা যে স্বতঃপ্রকাশিত। অহং প্ৰদীপ মাত্র, আর আত্মা যে আলোক | অহং-দীপ যখন এই দীপ্তিকে, এই আত্মাকে উপলব্ধি করে তখন সে কি আর অহংকারের সঞ্চয় নিয়ে থাকে ? তখন সে আপনার সব দিয়েই সেই আলোককেই প্ৰকাশ করে । * সে যে তাকে দেখেছে যিনি ঈশানাে ভূতভাব্যস্য, যিনি অতীত ও ভবিষ্যতের অধিপতি । সেইজন্যেই সে যে সেই বৃহৎ কালের ক্ষেত্রেই আপনাকে এবং সবকিছুকেই দেখতে পায়। সে তো কোনো সাময়িক আসক্তির দ্বারা বদ্ধ হয় না, কোনো সাময়িক ক্ষোভের দ্বারা বিচলিত হতে পারে না । এইজন্যই তার বাক্য ও কর্ম নিত্য হয়ে ওঠে । তা কালে কালে ক্রমশই প্রবলতর হয়ে ব্যক্ত হতে থাকে। যদি-বা কোনো এক সময়ে কোনো কারণে তা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, তবে নিজের আচ্ছাদনকে দগ্ধ করে আবার নবীনতর উজ্জ্বলতায় সে দীপ্যমান হয়ে ওঠে । মহৰ্ষির ৭ই পৌষের দীক্ষার উপরে আত্মার দীপ্তি পড়েছিল, তার উপরে ভূত-ভবিষ্যতের যিনি ঈশান তীর আবির্ভাব হয়েছিল। এইজন্যে সেই দীক্ষা ভিতরে থেকে তঁর জীবনকে ধনীগৃহের