পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Vod 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী কালেরই কারুকার্যে খচিত হয়েছিল । এইরকম এক দিকে তখনকার কালের সঙ্গে তখনকার কবির যোগ আমরা দেখতে পাই । কিন্তু এই প্রমোদভবনের স্বর্ণখচিত অন্তঃপুরের মাঝখানে বসে কাব্যলক্ষ্মী বৈরাগবিকল চিত্তে কিসের ধ্যানে নিযুক্ত ছিলেন ? হৃদয় তো তার এখানে ছিল না। তিনি এই আশ্চর্য কারুবিচিত্র মাণিক্যকঠিন কারাগার হতে কেবলই মুক্তিকামনা করছিলেন। কালিদাসের কাব্যে বাহিরের সঙ্গে ভিতরের, অবস্থার সঙ্গে আকাঙক্ষার একটা দ্বন্দ্ব আছে। ভারতবর্ষের যে তপস্যার যুগ। তখন অতীত হয়ে গিয়েছিল, ঐশ্বর্যশালী রাজসিংহাসনের পাশে বসে কবি সেই নির্মল সুদূর কালের দিকে একটি বেদনা বহন করে তাকিয়ে ছিলেন। রঘুবংশ কাব্যে তিনি ভারতবর্ষের পুরাকালীন সূর্যবংশীয় রাজাদের চরিতগানে যে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন তার মধ্যে কবির সেই বেদনটি নিগুঢ় হয়ে রয়েছে। তার প্রমাণ দেখুন। আমাদের দেশের কাব্যে পরিণামকে অশুভকরী ভাবে দেখানো ঠিক প্রথা নয় । বস্তুত যে রামচন্দ্রের জীবনে রঘুর বংশ উচ্চতম চূড়ায় অধিরোহণ করেছে, সেইখানেই কাব্য শেষ করলে তবেই কবির ভূমিকার কাব্যগুলি সার্থক হত । তিনি ভূমিকায় বলেছেন— সেই যারা জন্মকাল অবধি শুদ্ধ, যারা ফলপ্ৰাপ্তি অবধি। কর্মকরতেন, সমুদ্র অবধি যাদের রাজ্য, এবং স্বৰ্গ অবধি যাদের রথবাের্ক্স ; যথাবিধি যারা অগ্নিতে আহুতি দিতেন, যথাকাম যারা প্রার্থীদের অভাব পূর্ণ করতেন, যথাপরাধ যারা দণ্ড দিতেন এবং যথাকলে যারা জাগ্ৰত হতেন ; যারা ত্যাগের জন্যে অর্থ সঞ্চয় করতেন, র্যারা সত্যের জন্য মিতভাষী, যারা যশের জন্য জয় ইচ্ছা করতেন এবং সস্তানলাভের জন্য যাদের দারগ্রহণ ; শৈশবে র্যারা বিদ্যাভ্যাস করতেন, যৌবনে যাদের বিষয়সেবা ছিল, বার্ধক্যে যারা মুনিবৃত্তি গ্ৰহণ করতেন এবং যোগান্তে র্যাদের দেহত্যাগ হত— আমি বাকসম্পদে দরিদ্র হলেও সেই রঘুরাজদের বংশকীর্তন করব, কারণ তাদের গুণ আমার কর্ণে প্রবেশ করে আমাকে চঞ্চল করে তুলেছে। কিন্তু গুণকীর্তনেই এই কাব্যের শেষ নয়। কবিকে যে কিসে চঞ্চল করে তুলেছে, তা রঘুবংশের পরিণাম দেখলেই বুঝা যায়। রঘুবংশ যার নামে গৌরবলাভ করেছে তার জন্মকাহিনী কী ? তার আরম্ভ কোথায় ? তপােবনে দিলীপদম্পতির তপস্যাতেই এমন রাজা জন্মেছেন। কালিদাস র্তার রাজপ্ৰভুদের কাছে এই কথাটি নানা কাব্যে নানা কৌশলে বলেছেন যে, কঠিন তপস্যার ভিতর দিয়ে ছাড়া কোনো মহৎ ফললাভের কোনো সম্ভাবনা নেই। যে রঘু উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিমের সমস্ত রাজাকে বীরতেজে পরাভূত করে পৃথিবীতে একচ্ছত্র রাজত্ব বিস্তার করেছিলেন, তিনি তঁর পিতামাতার তপঃসাধনার ধন। আবার যে ভরত বীৰ্য্যবলে চক্রবর্তী সম্রাট হয়ে ভারতবর্ষকে নিজনামে ধন্য করেছেন তার জন্মঘটনায় অবারিত প্রবৃত্তির যে কলঙ্ক পড়েছিল, কবি তাকে তপস্যার অগ্নিতে দগ্ধ এবং দুঃখের অশ্রুজলে সম্পূর্ণ ধৌত না করে ছাড়েন নি । রঘুবংশ আরম্ভ হল রাজ্যোচিত ঐশ্বৰ্যগৌরবের বর্ণনায় নয়। সুদক্ষিণাকে বামে নিয়ে রাজা দিলীপ তপোবনে প্রবেশ করলেন । চতুঃসমুদ্র র্যার অনন্যশাসনা পৃথিবীর পরিখা সেই রাজা অবিচলিত নিষ্ঠায় কঠোর সংযমে তপোবনধেনুর সেবায় নিযুক্ত হলেন । সংযমে তপস্যায় তপোবনে রঘুবংশের আরম্ভ, আর মদিরায় ইন্দ্ৰিয়মত্ততায় প্রমোদভবনে তার উপসংহার । এই শেষ সর্গের চিত্রে বর্ণনার উজ্জ্বলতা যথেষ্ট আছে। কিন্তু যে অগ্নি লোকালয়কে দগ্ধ করে সর্বনাশ করে সেও তো কম উজ্জ্বল নয় । এক পত্নীকে নিয়ে দিলীপের তপোবনে বাস শান্ত এবং অনতিপ্রকট বর্ণে অঙ্কিত, আর বহু নায়িকা নিয়ে অগ্নিবর্ণের আত্মঘাতসাধন অসমবৃত বাহুল্যের সঙ্গে যেন জ্বলন্ত রেখায় বর্ণিত । প্রভাত যেমন শান্ত, যেমন পিঙ্গলজটাধারী ঋষিবালকের মতো পবিত্র, প্রভাত যেমন মুক্ত পাণ্ডুর সীেমা আলোকে শিশিরস্নিগ্ধ পৃথিবীর উপরে ধীরপদে অবতরণ করে এবং নবজীবনের অভু্যদয় বার্তায়