পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন ዓ O(፩ আজ ছুটির শেষে আমরা আবার আমাদের কর্মক্ষেত্রে এসে পীেচেছি। এবার কি আবার নূতন দৃষ্টিতে কর্মকে দেখছি না ? এই কর্মের মর্মগত সত্যটি অভ্যাসবশত আমাদের কাছে স্নান হয়ে গিয়েছিল ; তাকে পুনরায় উজ্জ্বল করে দেখে কি আনন্দ বোধ হচ্ছে না ? এ আনন্দ কিসের জন্যে ? এ কি সফলতার মূর্তিকে প্রত্যক্ষ দেখে ? এ কি এই মনে করে যে, আমরা যা করতে চেয়েছিলুম তা করে তুলেছি ? এ কি আমাদের আত্মকীর্তির গর্বানুভবের আনন্দ ? তা নয়। কর্মকেই চরম মনে করে তার মধ্যে ডুবে থাকলে মানুষ কর্মকে নিয়ে আত্মশক্তির গর্ব উপলব্ধি করে। কিন্তু কর্মের ভিতরকার সত্যকে যখন আমরা দেখি তখন কর্মের চেয়ে বহুগুণে বড়ো জিনিসটিকে দেখি। তখন যেমন আমাদের অহংকার দূর হয়ে যায়, সন্ত্রমে মাথা নত হয়ে পড়ে, তেমনি আর-এক দিকে আনন্দে আমাদের বক্ষ বিশ্বফারিত হয়ে ওঠে। তখন আমাদের আনন্দময় প্রভুকে দেখতে পাই, কেবল লীেহময় কলের আস্ফালনকে দেখি না। এখানকার এই বিদ্যালয়ের মধ্যে একটি মঙ্গলচেষ্টা আছে। কিন্তু সে কি কেবল একটি মঙ্গলের কল মাত্র । কেবল নিয়ম-রচনা এবং নিয়মে চালানো ? কেবল ভাষা শেখানো, অঙ্ক কষানো, খেটে মরা এবং খাটিয়ে মারা ? কেবল মস্ত একটা ইস্কুল তৈরি করে মনে করা খুব একটা ফল পেলুম ? তা নয় । এই চেষ্টাকে বড়ো করে দেখা, এই চেষ্টার ফলকেই বড়ো ফল বলে গর্ব করা সে নিতান্তই ফাকি । মঙ্গল-অনুষ্ঠানে মঙ্গলাফল লাভ হয় সন্দেহ নেই। কিন্তু সে গীেণ ফল মাত্র। আসল কথাটি এই যে, মঙ্গলকার্মের মধ্যে মঙ্গলময়ের আবির্ভাব আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যদি ঠিক জায়গায় দৃষ্টি মেলে দেখি তবে মঙ্গলকার্মের উপরে সেই বিশ্বমঙ্গলকে দেখতে পাই। মঙ্গল-অনুষ্ঠানের চরম সার্থকতা তাই। মঙ্গলকর্ম সেই বিশ্বকর্মকে সত্যদৃষ্টিতে দেখবার একটি সাধনা। অলস যে, সে তাকে দেখতে পায় না। নিরুদ্যম যে, তার চিত্তে তার প্রকাশ আচ্ছন্ন । এইজন্যই কর্ম, নইলে কর্মের মধ্যেই কর্মের গৌরব থাকতে পারে না | যদি মনে জানি আমাদের এই কর্ম সেই কল্যাণময় বিশ্বকর্মকেই লাভ করবার একটি সাধনা, তা হলে কর্মের মধ্যে যা-কিছু বিঘ্ন অভাব প্রতিকূলতা আছে তা আমাদের হতাশ করতে পারে না। কারণ, বিঘুকে অতিক্রম করাই যে আমাদের সাধনার অঙ্গ। বিঘ্ন না থাকলে যে আমাদের সাধনাই অসম্পূর্ণ হয়। তখন প্রতিকূলতাকে দেখলে কর্মনাশের ভয়ে আমরা ব্যাকুল হয়ে উঠি নে, কারণ, কর্মফলের চেয়ে আরো যে বড়ো ফল আছে। প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করলে আমরা কৃতকার্য হব বলে কোমর বাধলে চলবে না, বস্তুত কৃতকার্য হব কি না তা জানি নে। কিন্তু প্রতিকূলতার সহিত সংগ্ৰাম করতে করতে আমাদের অন্তরের বাধা ক্ষয় হয়, তাতে আমাদের তেজ ভস্মমুক্ত হয়ে ক্রমশ দীপ্যমান হয়ে ওঠে এবং সেই দীপ্তিতেই, যিনি বিশ্বপ্রকাশ, আমার চিত্তে র্তার প্রকাশ উন্মুক্ত হতে থাকে। আনন্দিত হও যে, কর্মে বাধা আছে। আনন্দিত হও যে, কর্মকরতে গেলেই তােমাকে নানা দিক থেকে নানা আঘাত সইতে হবে এবং তুমি যেমনটি কল্পনা করছি বারংবার তার পরাভব ঘটবে। আনন্দিত হও যে, লোকে তোমাকে ভুল বুঝবে ও অপমানিত করবে। আনন্দিত হও যে, তুমি যে বেতনটি পাবে বলে লোভ করে বসেছিলে বারংবার তা হতে বঞ্চিত হবে। কারণ, সেই তাে সাধনা। যে ব্যক্তি আগুন জ্বালতে চায় সে ব্যক্তির কাঠ পুড়ছে বলে দুঃখ করলে চলবে কেন ? যে কৃপণ শুধু শুষ্ক কাঠই ভূপাকার করে তুলতে চায় তার কথা ছেড়ে দাও। তাই ছুটির পরে কর্মের সমস্ত বাধাবিঘ্ন সমস্ত অভাব অসম্পূর্ণতার মধ্যে আজ আনন্দের সঙ্গে প্রবেশ করছি। কাকে দেখে ? যিনি কর্মের উপরে বসে আছেন তার দিকেই চেয়ে । র্তার দিকে চাইলে কর্মের বল বাড়ে অথচ উগ্রতা চলে যায়। চেষ্টার চেষ্টারূপ আর দেখতে পাই । নে, তার শান্তিমূর্তিই ব্যক্ত হয়। কাজ চলতে থাকে অথচ স্তব্ধতা আসে, ভরা জোয়ারের জলের মতো সমস্ত থমথম করতে থাকে। ডাকাডাকি হাঁকাইকি ঘোষণা রটনা এ সমস্ত একেবারেই ঘুচে যায়। চিন্তায় বাক্যে কর্মে বাড়াবাড়ি কিছুমাত্র থাকে না। শক্তি তখন আপনাকে আপনি আড়াল করে দিয়ে সুন্দর হয়ে ওঠে— যেমন সুন্দর আজকের এই সন্ধ্যাকাশের নক্ষত্রমণ্ডলী। তার প্রচণ্ড তেজ, প্রবল ।