পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন Ꮔ ᏚᏔᏬ ভিতর দিয়েই সে পথ চলে গিয়েছে এবং সমস্তর ভিতর দিয়েই সেই পরমচৈতন্যস্বরূপের কাছে গিয়ে পৌচেছে যিনি সমস্তকেই আচ্ছন্ন করে রয়েছেন। তার পর থেকে তিনি নদী পর্বত সমুদ্র প্রান্তরে যেখানেই ঘুরে বেড়িয়েছেন। কোথাও আর তার প্রিয়তমকে হারান নি- কেননা তিনি যে সর্বত্রই আর তিনি যে আত্মার মাঝখানেই । যিনি আত্মার ভিতরেই তাকেই আবার দেশে দেশে দিকে দিকে সর্বত্রই ব্যাপক ভাবে দেখতে পাবার কত সুখ, যিনি বিশাল বিশ্বের সমস্ত বৈচিত্র্যের মধ্যে রূপ রস গীত গন্ধের নব নব রহস্যকে নিত্য নিত্য জাগিয়ে তুলে সমস্তকে আচ্ছন্ন করে রয়েছেন তাকেই আত্মার অন্তরতম নিভৃতে নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করবার কত আনন্দ ! এই উপলব্ধি করার মন্ত্রই হচ্ছে গায়ত্রী। অন্তরকে এবং বাহিরকে, বিশ্বকে এবং আত্মাকে একের মধ্যে যোগযুক্ত করে জানাই হচ্ছে এই মন্ত্রের সাধনা এবং সাধনাই ছিল মহর্ষির জীবনের সাধনা | জীবনের এই সাধনাটিকে তিনি তীর উপদেশ ও বক্তৃতার মধ্যে ভাষার দ্বারা প্রকাশ করেছেন, কিন্তু সকলের চেয়ে সম্পূর্ণ সৌন্দর্যে প্রকাশ পেয়েছে শান্তিনিকেতন আশ্রমটির মধ্যে। কারণ, এই প্রকাশের ভার তিনি একলা নেন নি। এই প্রকাশের কাজে এক দিকে তীর ভগবৎ-পূজায়-উৎসর্গ করা সমস্ত জীবনটি রয়ে গেছে, আর-এক দিকে আছে সেই প্রান্তর, সেই আকাশ, সেই তরুশ্রেণী— এই দুই এখানে মিলিত হয়েছে, ভুর্ভূবঃ স্বঃ এবং ধিয়ঃ । এমনি করে গায়ত্রী মন্ত্র যেখানেই প্রত্যক্ষরূপ ধারণ করেছে, যেখানেই সাধকের মঙ্গলপূর্ণ চিত্তের সঙ্গে প্রকৃতির শান্তিপূর্ণ সৌন্দর্য মিলিত হয়ে গেছে, সেইখানেই পুণ্যতীর্থ। আমরা যারা এই আশ্রমে বাস করছি, হে শান্তিনিকেতনের অধিদেবতা, আজ উৎসবের শুভদিনে তোমার কাছে আমাদের এই প্রার্থনা, তুমি আমাদের সেই চেতনাটি সর্বদা জাগিয়ে রেখে দাও যাতে আমরা যথার্থ তীৰ্থবাসী হয়ে উঠতে পারি। গ্রন্থের মধ্যে কীট যেমন তীক্ষ ক্ষুধার দংশনে গ্ৰন্থকে কেবল নষ্টই করে, তার সত্যকে লেশমাত্রও লাভ কয়ে না, আমরাও যেন তেমনি করে নিজেদের অসংযত প্রবৃত্তি-সকল নিয়ে এই আশ্রমের মধ্যে কেবল ছিদ্র বিস্তার করতে না থাকি, আমরা এর ভিতরকার আনন্দময় সত্যটিকে যেন প্রতিদিন জীবনের মধ্যে গ্ৰহণ করবার জন্যে প্রস্তুত হতে পারি। আমরা যে সুযোগ যে অধিকার পেয়েছি অচেতন হয়ে কেবলই যেন তাকে নষ্ট করতে না থাকি । এখানে যে সাধকের চিত্তটি রয়েছে সে যেন আমাদের চিত্তকে উদবোধিত করে তোলে, যে মন্ত্রটি রয়েছে সে যেন আমাদের মননের মধ্যে ধ্বনিত হয়ে ওঠে ; আমরাও যেন আমাদের জীবনটিকে এই আশ্রমের সঙ্গে এমনভাবে মিলিয়ে যেতে পারি যে, সেটি এখানকার পক্ষে চিরদিনের দানম্বরূপ হয়। হে আশ্রমদেব, দেওয়া এবং পাওয়া যে একই কথা । আমরা যদি নিজেকে না দিতে পারি তা হলে আমরা পাবও না, আমরা যদি এখন থেকে কিছু পেয়ে যাই এমন ভাগ্য আমাদের হয় তা হলে আমরা দিয়েও যাব। তা হলে আমাদের জীবনটি আশ্রমের তরুপল্লবের মর্মরধ্বনির মধ্যে চিরকাল মর্মরিত হতে থাকবে । এখানকার আকাশের নির্মল নীলিমার মধ্যে আমরা মিশব, এখানকার প্রান্তরের উদার বিস্তারের মধ্যে আমরা বিস্তীর্ণ হব, আমাদের আনন্দ এখানকার পথিকদের স্পর্শ করবে, এখানকার অতিথিদের অভ্যর্থনা করবে। এখানে যে সৃষ্টিকার্যটি নিঃশব্দে চিরদিনই চলছে তারই মধ্যে আমরাও চিরকালের মতো ধরা পড়ে যাব । বৎসরের পর বৎসর। যেমন আসবে, ঋতুর পর ঋতু। যেমন ফিরবে, তেমনি এখানকার শালবনে ফুল ফোটার মধ্যে, পূর্বদিগন্তে মেঘ ওঠার মধ্যে, এই কথাটি চিরদিন ফিরে ফিরে আসবে, ঘুরে ঘুরে বেড়াবে যে- হে আনন্দময়, তোমার মধ্যে আনন্দ পেয়েছি ; হে সুন্দর, তোমার পানে চেয়ে মুগ্ধ হয়েছি ; হে পবিত্র, তোমার শুভ্ৰ হস্ত আমার হৃদয়কে স্পর্শ করেছে ; হে অন্তরের ধন, তোমাকে বাহিরে পেয়েছি ; হে বাহিরের ঈশ্বর, তোমাকে অন্তরের মধ্যে লাভ করেছি। হে ভক্তের হৃদয়ানন্দ, আমরা যে তোমাকে সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে ভক্তি করতে পারি। নে তার একটিমাত্র কারণ এই, আমরা তোমার মতো হতে পারিনি। তুমি আত্মদা, বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডে তুমি আপনাকে অজস্র দান করছি। আমরা স্বাৰ্থ নিয়েই আছি, আমাদের ভিক্ষুকতা কিছুতেই ঘোচে না। আমাদের কর্ম