পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ ՀՆ রবীন্দ্র-রচনাবলী মহতী বিনষ্টি হতে কে আমাদের বঁাচাবে ? আমাদের সত্য করে তুলবে কিসে? এর যে যথার্থ উত্তর সে আমাদের দেশেই আছে- ইহ চেৎ আবেদীৎ অৰ্থ সত্যমস্তি, ন চেৎ ইহ আবেদীৎ মহতী বিনষ্টিঃ । ইহাকে যদি জানা গেল। তবেই সত্য হওয়া গেল, ইহাকে যদি না জানা গেল। তবেই মহাবিনাশ। একে কেমন করে জানতে হবে ? না, ভূতেষু ভূতেষু বিচিন্ত্য। প্রত্যেকের মধ্যে, সকলেরই মধ্যে, তাকে চিন্তা করে, তাকে দর্শন করে। গৃহেই বলো, সমাজেই বলো, রাষ্ট্রেই বলো, যে-পরিমাণে সকলের মধ্যে আমরা সেই সর্বানুভুকে উপলব্ধি করি সেই পরিমাণেই সত্য হই; যে-পরিমাণে না করি সেই পরিমাণেই আমাদের বিনাশ । এইজন্য সকল দেশের সর্বত্রই মানুষ জেনে এবং না জেনে এই সাধনাই করছে, সে বিশ্বানুভূতির মধ্যেই আত্মার সত্য উপলব্ধি খুঁজছে, সকলের মধ্যে দিয়ে সেই এককেই সে চাচ্ছে, কেননা সেই একই অমৃত, সেই একের থেকে বিচ্ছিন্নতাই মৃত্যু। কিন্তু আমার মনে কোনাে নৈরাশ্য নেই। আমি জানি অভাব যেখানে অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে মূর্তি ধারণ করে সেখানেই তার প্রতিকারের শক্তি সম্পূর্ণ বেগে প্রবল হয়ে ওঠে। আজ যে-সকল দেশ স্বজাতি স্বরাজ্য সাম্রাজ্য প্রভৃতি নিয়ে অত্যন্ত ব্যাপৃত হয়ে আছে তারাও বিশ্বের ভিতর দিয়ে সেই পরম একের সন্ধানে সজ্ঞানে প্ৰবৃত্ত নেই, তারাও সেই একের বোধকে এক জায়গায় এসে আঘাত করছে, কিন্তু তবু তারা বৃহতের অভিমুখে আছে— একটা বিশেষ সীমার মধ্যে ঐক্যবােধকে তারা প্রশস্ত করে নিয়েছে। সেইজন্যে জ্ঞানে ভাবে কর্মে এখনো তারা ব্যাপ্ত হচ্ছে, তাদের শক্তি এখনো কোথাও তেমন করে অভিহিত হয় নি। তারা চলেছে, তারা বদ্ধ হয় নি। কিন্তু সেইজন্যেই তাদের পক্ষে সুস্পষ্ট করে বােঝা শক্ত পরম পাওয়াটি কী ? তারা মনে করছে তারা যা নিয়ে আছে তাই বুঝি চরম, এর পরে বুঝি আর কিছু নেই, যদি থাকে মানুষের তাতে প্রয়োজন নেই। তারা মনে করে মানুষের যা-কিছু প্রয়োজন তা বুঝি ভোট দেবার অধিকারের উপর নির্ভর করছে, আজকালকার দিনের উন্নতি বলতে লোকে যা বোঝে তাই বুঝি মানুষের চরম অবলম্বন। কিন্তু বিধাতা এই ভারতবর্ষেই সমস্যাকে সব চেয়ে ঘনীভূত করে তুলেছেন, সেইজন্যে আমাদেরই এই সমস্যার আসল উত্তরটি দিতে হবে, এবং এর উত্তর আমাদের দেশের বাণীতে যেমন অত্যন্ত স্পষ্ট করে ব্যক্ত হয়েছে এমন আর কোথাও হয় নি। — · যন্তু সর্বাণি ভূতানি আত্মন্যেবানুপশ্যতি সর্বভুতেষু চাত্মানং ন ততো বিজুগুপ্তসতে । যিনি সমস্ত ভূতকে পরমাত্মার মধ্যেই দেখেন এবং পরমাত্মাকে সর্বভূতের মধ্যে দেখেন, তিনি আর কাউকেই ঘূণা করেন না । সর্বব্যাপী স ভগবান তস্মাৎ সর্বগতঃ শিবঃ | সেই ভগবান সর্বব্যাপী, এইজন্যে তিনিই হচ্ছেন সর্বগত মঙ্গল । বিভাগের দ্বারা, বিরোধের দ্বারা যতই তাকে খণ্ডিত করে জানব ততই সেই সর্বগত মঙ্গলকে বাধা দেব । একদিন ভারতবর্ষের বাণীতে মানুষের সকলের চেয়ে বড়ো সমস্যার যে উত্তর দেওয়া হয়েছে, আজ ইতিহাসের মধ্যে আমাদের সেই উত্তরটি দিতে হবে । আজ আমাদের দেশে নানা জাতি এসেছে, বিপরীত দিক থেকে নানা বিরুদ্ধ শক্তি এসে পড়েছে, মতের অনৈক্য, আচারের পার্থক্য, স্বার্থের সংঘাত ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। আমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে ভারতবর্ষের বাণীকে আজই সত্য করে তোেলবার সময় এসেছে । যতক্ষণ তা না করব ততক্ষণ বার বার কেবলই আঘাত পেতে থাকিব, কেবলই অপমান কেবলই ব্যর্থতা ঘটতে থাকবে, বিধাতা একদিনের জন্যেও আমাদের আরামে বিশ্রাম করতে দেবেন না । আমরা মানুষের সমস্ত বিচ্ছিন্নতা মিটিয়ে দিয়ে তাকে যে এক করে জািনবার সাধনা করব তার কারণ এ নয় যে সেই উপায়ে আমরা প্রবল হব, আমাদের বাণিজ্য ছড়িয়ে পড়বে, আমাদের স্বজাতি সকল জাতির চেয়ে বড়ো হয়ে উঠবে। কিন্তু তার একটিমাত্র কারণ এই যে, সকল মানুষের ভিতর দিয়ে আমাদের আত্মা সেই ভূমার মধ্যে সত্য হয়ে উঠবে যিনি ‘সর্বগতঃ শিবঃ, যিনি ‘সর্বভূতগুহাশয়ঃ', যিনি