পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ Տ)O ভোলানাথ গ্রন্থে (১৩৫০) এবং রচনাবলী-সংস্করণে (১৩৪৯) নূতন সংকলিত হইয়াছে। শিশু ভোলানাথ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারিতে (যাত্রী) লিখিয়াছেন : একজন অপরিচিত যুবকের সঙ্গে একদিন এক-মোটরে নিমন্ত্রণ সভায় যাচ্ছিলুম। তিনি আমাকে কথাপ্রসঙ্গে খবর দিলেন যে, আজকাল পদ্য আকারে যে-সব রচনা করছি সেগুলি লোকে তেমন পছন্দ করছে না। যারা পছন্দ করছে না। তাদের সুযোগ্য প্ৰতিনিধিস্বরূপে তিনি উল্লেখ করলেন তার কোনো কোনো আত্নীয়ের কথা- সেই আত্মীয়েরা কবি ; আর যে-সব পদ্য-রচনা লোকে পছন্দ করে না, তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন আমার গানগুলো, আর আমার শিশু ভোলানাথ নামক আধুনিক কাব্যগ্রন্থ। তিনি বললেন, আমার বন্ধুরাও আশঙ্কা করছেন আমার কাব্য লেখবার শক্তি ক্রমেই স্নান হয়ে আসছে । কালের ধর্মই এই। মর্তলোকে বসন্ত-ঋতু চিরকাল থাকে না । মানুষের ক্ষমতার ক্ষয় আছে, অবসান আছে। যদি কখনো কিছু দিয়ে থাকি, তবে মূল্য দেবার সময় তারই হিসাবটা স্মরণ করা ভালো | রাত্রিশেষে দীপের আলো নেববার সময় যখন সে তার শিখার পাখাতে বার-কতক শেষ ঝাপটা দিয়ে লীলা সাঙ্গ করে, তখন আশা দিয়ে নিরাশ করবার দাবিতে প্ৰদীপের নামে নালিশ করাটা বৈধ নয়। দাবিটাই যার বেহিসাবী, দাবি অপূরণ হবার হিসাবটাতেও তার ভুল থাকবেই। পঁচানব্বই বছর বয়সে একটা মানুষ ফস করে মারা গেল বলে চিকিৎসাশাস্ত্রটাকে ধিক্কার দেওয়া বৃথা বাক্যব্যয় । অতএব কেউ যদি বলে আমার বয়স যতই বাড়ছে আমার আয়ু ততই কমে যাচ্ছে, তা হলে তাকে আমি নিন্দুক বলি নে, বড়োজের এই বলি যে, লোকটা বাজে কথা এমনভাবে বলে যেন সেটা দৈববাণী। কালক্রমে আমার ক্ষমতা হ্রাস হয়ে যাচ্ছে, এই বিধিলিপি নিয়ে যুবক হােক বৃদ্ধ হােক, কবি হােক অকবি হােক, কারও সঙ্গে তকরার করার চেয়ে ততক্ষণ একটা গান লেখা ভালো মনে করি, তা সেটা পছন্দসই হােক আর না হােক | এমন-কি, সেই অবসরে শিশু ভোলানাথের জাতের কবিতা যদি লিখতে পারি, তা হলেও মনটা খুশি থাকে।-- ঐ শিশু ভোলানাথের কবিতাগুলো খামক কেন লিখতে বসেছিলুম ? সেও লোকরঞ্জনের জন্যে নয়, নিতান্ত নিজের গরজে । পূর্বেই বলেছি, কিছুকাল আমেরিকার প্রৌঢ়তার মরুপরে ঘোরতর কার্যপটুতার পাথরের দুর্গে আটকা পড়েছিলুম। সেদিন খুব স্পষ্ট বুঝেছিলুম জমিয়ে তোলবার মতো । এতবড়ো মিথ্যে ব্যাপার জগতে আর কিছুই নেই। এই জমাবার জমাদারটা বিশ্বের চিরাচঞ্চলতাকে বাধা দেবার স্পর্ধা করে ; কিন্তু কিছুই থাকবে না, আজ বাদে কাল সব সাফ হয়ে যাবে। যে-শ্রোতের ঘূর্ণিপাকে এক-এক জায়গায় এই সব বস্তুর পিণ্ডগুলোকে স্তৃপকার করে দিয়ে গেছে, সেই স্রোতেরই অবিরত বেগে ঠেলে ঠেলে সমস্ত ভাসিয়ে নীল সমুদ্রে নিয়ে যাবে— পৃথিবীর বক্ষ সুস্থ হবে। পৃথিবীতে সৃষ্টির যে লীলাশক্তি আছে সে যে নির্লোভ, সে নিরাসক্ত, সে অকৃপণ— সে কিছু জমতে দেয় না ; কেননা জমার জঞ্জালে তার সৃষ্টির পথ আটকায়— সে যে নিত্যনূতনের নিরন্তর প্রকাশের জন্যে তার অবকাশকে নির্মল করে রেখে দিতে চায়। লোভী মানুষ কোথা থেকে জঞ্জাল জড়ো করে সেইগুলোকে আগলে রাখবার জন্যে নিগড়িবদ্ধ লক্ষ লক্ষ দাসকে দিয়ে প্ৰকাণ্ড সব ভাণ্ডার তৈরি করে তুলছে। সেই ধ্বংসশাপগ্ৰস্ত ভাণ্ডারের কারাগারে জড়বস্তুপুঞ্জের অন্ধকারে বাসা বেঁধে সঞ্চয়-গর্বের ঔদ্ধত্যে মহাকালকে কৃপণটা বিদ্রুপ করছে— এ বিদ্যুপ মহাকাল কখনোই সইবে না । আকাশের উপর দিয়ে যেমন ঢ় আঁধি ক্ষণকালের জন্যে সূর্যকে পরাভূত করে দিয়ে তার পরে নিজের দীেরাত্ম্যের কোনো চিহ্ন না রেখে চলে যায়, এ-সব তেমনি করেই শূন্যের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।